চিরকুমার-সভা

বিপিন। তবে ইতিহাসটা বলি শোনো। জানই তো, পূর্ণ সন্ধ্যাবেলায় চন্দ্রবাবুর কাছে পড়ার নোট নিতে যায়। সেদিন আমি আর পূর্ণ একসঙ্গেই একটু সকাল সকাল চন্দ্রবাবুর বাসায় এসেছিলেম। তিনি একটা মিটিং থেকে সবে এসেছেন। বেহারা কেরোসিন জ্বেলে দিয়ে গেছে, পূর্ণ বইয়ের পাতা ওল্টাচ্ছে, এমন সময় — কী আর বলব ভাই, সে যেন বঙ্কিমবাবুর কোন্‌ এক অলিখিত নভেলের ভিতর থেকে বেরিয়ে এল এক কন্যে, পিঠে দুলছে বেণী —

শ্রীশ। বল কী, বল কী বিপিন।

বিপিন। শোনোই - না। এক হাতে থালায় করে চন্দ্রবাবুর জন্যে জলখাবার, আর-এক হাতে জলের গ্লাস নিয়ে হঠাৎ ঘরের মধ্যে এসে উপস্থিত। আমাদের দেখেই তো কুণ্ঠিত, সচকিত, লজ্জায় মুখ রক্তিমবর্ণ। হাত জোড়া, মাথায় কাপড় দেবার জো নেই। তাড়াতাড়ি টেবিলের উপর খাবার রেখেই ছুট। পূর্ণর মুখ দেখেই বোঝা গেল, তার মনটা দোদুল্যমান বেণীর পিছন পিছন ছুটেছে। ব্রাহ্ম বটে, কিন্তু তেত্রিশ কোটির সঙ্গে লজ্জাকে বিসর্জন দেয় নি এবং সত্য বলছি শ্রীকেও রক্ষা করেছে।

শ্রীশ। বল কী বিপিন, দেখতে ভালো বুঝি।

বিপিন। দিব্যি দেখতে। হঠাৎ যেন বিদ্যুতের মতো এসে পড়ে পড়াশুনোয় বজ্রাঘাত করে গেল।

শ্রীশ। আহা, কই আমি তো একদিনও দেখি নি। মেয়েটি কে হে।

বিপিন। আমাদের সভাপতির ভাগ্নী, নাম নির্মলা।

শ্রীশ। ভাগ্নী? সর্বনাশ! এইখানেই থাকেন?

বিপিন। সন্দেহমাত্র নেই। সভাপতিমশায় নিজে নীরোগ, কিন্তু রোগের ছোঁয়াচ নিয়ে ফেরেন।

শ্রীশ। কিন্তু ভাগ্নেজামাই ব'লে বালাই নেই বুঝি?

বিপিন। সে বালাইটি অপরিণীত আকারে চিরকুমার-সভায় ঢুকে পড়েছে। পূর্ণ পরিণত আকারে যখন বেরিয়ে পড়বে তখন প্রজাপতি কুমার - সভার গুটি বিদীর্ণ করে দেবেন।

শ্রীশ। তিনি তবে কুমারী?

বিপিন। কুমারী বৈকি। কুমার - সভার মহামারী। এই ঘটনার ঠিক পরেই পূর্ণ হঠাৎ আমাদের কুমার - সভায় নাম লিখিয়েছে।

শ্রীশ। পূজারি সেজে ঠাকুর চুরি করবার মতলব। আমাকেও তো ব্যাপারটা পর্যবেক্ষণ করতে হবে।

বিপিন। নারীতত্ত্বের গবেষণা স্বাস্থ্যকর না হতে পারে।

শ্রীশ। তোমার স্বাস্থ্যের যদি ব্যাঘাত না হয়ে থাকে তা হলে আমারও —

বিপিন। আরম্ভেতে রোগের প্রবেশ ধরা পড়ে না। কিন্তু, কুমারের মার যখন ভিতর থেকে ফুটে উঠবে তখন অশ্বিনীকুমারেরও সাধ্য নেই রক্ষা করে। গোড়ায় সাবধান হওয়া ভালো।

একটি প্রৌঢ় ব্যক্তির প্রবেশ

বিপিন। কী মশায়, আপনি কে।

প্রৌঢ় ব্যক্তি। আজ্ঞে, আমার নাম শ্রীবনমালী ভট্টাচার্য, ঠাকুরের নাম ৺রামকমল ন্যায়চঞ্চু, নিবাস —

শ্রীশ। আর অধিক আমাদের ঔৎ সুক্য নেই। এখন কী কাজে এসেছেন সেইটে —

বনমালী। কাজ কিছুই নয়। আপনারা ভদ্রলোক, আপনাদের সঙ্গে আলাপ-পরিচয় —

শ্রীশ। কাজ আপনার না থাকে আমাদের আছে। এখন, অন্য কোনো ভদ্রলোকের সঙ্গে যদি আলাপ - পরিচয় করতে যান