চিরকুমার-সভা
তা হলে আমাদের একটু —

বনমালী। তবে কাজের কথাটা সেরে নিই।

শ্রীশ। সেই ভালো।

বনমালী। কুমারটুলির নীলমাধব চৌধুরি - মশায়ের দুটি পরমাসুন্দরী কন্যা আছে — তাঁদের বিবাহযোগ্য বয়স হয়েছে -

শ্রীশ। হয়েছে তো হয়েছে, আমাদের সঙ্গে তার সম্বন্ধটা কী।

বনমালী। সম্বন্ধ তো আপনারা একটু মনোযোগ করলেই হতে পারে। সে আর শক্ত কী। আমি সমস্তই ঠিক করে দেব।

বিপিন। আপনার এত দয়া অপাত্রে অপব্যয় করছেন।

বনমালী। অপাত্র! বিলক্ষণ! আপনাদের মতো সৎ পাত্র পাব কোথায়। আপনাদের বিনয়গুণে আরো মুগ্ধ হলেম।

শ্রীশ। এই মুগ্ধভাব যদি রাখতে চান তা হলে এইবেলা সরে পড়ুন। বিনয়গুণে অধিক টান সয় না।

বনমালী। কন্যার বাপ যথেষ্ট টাকা দিতে রাজি আছেন।

শ্রীশ। শহরে ভিক্ষুকের তো অভাব নেই। ওহে বিপিন, তোমার আমোদ বোধ হচ্ছে, কিন্তু এরকম সদালাপ আমার ভালো লাগে না।

বিপিন। পালাই কোথায়। ভগবান এঁকেও যে লম্বা একজোড়া পা দিয়েছেন।

শ্রীশ। যদি পিছু ধরেন তা হলে ভগবানের সেই দান মানুষের হাতে প'ড়ে খোয়াতে হবে।

বনমালী। আমিই যাই।

[ প্রস্থান

চন্দ্রমাধববাবুর প্রবেশ

চন্দ্রবাবু। পূর্ণ!

শ্রীশ। আজ্ঞে, আমি শ্রীশ।

চন্দ্রবাবু। আমাদের এই সভার সভ্যসংখ্যা অল্প হওয়াতে কারো হতাশ্বাস হবার কোনো কারণ নেই —

শ্রীশ। হতাশ্বাস? সেই তো আমাদের সভার গৌরব। এ সভার মহৎ আদর্শ এবং কঠিন বিধান কি সর্বসাধারণের উপযুক্ত। আমাদের সভা অল্প লোকের সভা।

চন্দ্রবাবু। ( কার্যবিবরণের খাতাটা চোখের কাছে তুলিয়া ) কিন্তু আমাদের আদর্শ উন্নত এবং বিধান কঠিন বলেই আমাদের বিনয় রক্ষা করা কর্তব্য ; সর্বদাই মনে রাখা উচিত আমরা আমাদের সংকল্পসাধনের যোগ্য না হতেও পারি। ভেবে দেখো পূর্বে আমাদের মধ্যে এমন অনেক সভ্য ছিলেন যাঁরা হয়তো আমাদের চেয়ে সর্বাংশে মহত্তর ছিলেন, কিন্তু তাঁরাও নিজের সুখ এবং সংসারের প্রবল আকর্ষণে একে একে লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছেন। আমাদের কয়জনের পথেও যে প্রলোভন কোথায় অপেক্ষা করছে তা কেউ বলতে পারে না। সেইজন্য আমরা দম্ভ পরিত্যাগ করব এবং কোনো রকম শপথেও বদ্ধ হতে চাই নে। আমাদের মত এই যে, কোনো কালে মহৎ চেষ্টাকে মনে স্থান না দেওয়ার চেয়ে চেষ্টা করে অকৃতকার্য হওয়া ভালো।

পাশের ঘরে ঈষৎ - মুক্ত দরজার অন্তরালে একটি শ্রোত্রী এই কথায় যে একটুখানি বিচলিত হইয়া

উঠিল, তাহার অঞ্চলবদ্ধ চাবির গোছায় দুই - একটা চাবি যে একটু ঠুন শব্দ করিল

তাহা পূর্ণ ছাড়া আর কেহ লক্ষ্য করিতে পারিল না।