প্রকল্প সম্বন্ধেপ্রকল্প রূপায়ণেরবীন্দ্র-রচনাবলীজ্ঞাতব্য বিষয়পাঠকের চোখেআমাদের লিখুনডাউনলোডঅন্যান্য রচনা-সম্ভার |
বাঁশরি। আজ রাগ করবেন না, ধৈর্য ধরবেন, কিছু প্রশ্ন করব।
পুরন্দর। আচ্ছা, বলো তুমি।
বাঁশরি। জিজ্ঞাসা করি, সোমশংকরকে শ্রদ্ধা করেন আপনি? ওকে খেলার পুতুল বলে মনে করেন না?
পুরন্দর। বিশেষ শ্রদ্ধা করি।
বাঁশরি। তবে কেন এমন মেয়ের ভার দিচ্ছেন ওর হাতে যে ওকে ভালোবাসে না।
পুরন্দর। জান না এ অতি মহৎ ভার, একই কালে ক্ষত্রিয়ের পুরস্কার এবং পরীক্ষা। সোমশংকরই এই ভার গ্রহণ করবার যোগ্য।
বাঁশরি। যোগ্য বলেই ওর চিরজীবনের সুখ নষ্ট করতে চান আপনি?
পুরন্দর। সুখকে উপেক্ষা করতে পারে ঐ বীর মনের আনন্দে।
বাঁশরি। আপনি মানবপ্রকৃতিকে মানেন না?
পুরন্দর। মানবপ্রকৃতিকেই মানি, তার চেয়ে নিচের প্রকৃতিকে নয়।
বাঁশরি। এতই যদি হল, ওরা বিয়ে নাই করত?
পুরন্দর। ব্রতকে নিষ্কামভাবে পোষণ করবে মেয়ে, ব্রতকে নিষ্কামভাবে প্রয়োগ করবে পুরুষ, এই কথা মনে করে দুটি মেয়ে-পুরুষ অনেকদিন খুঁজেছি। দৈবাৎ পেয়েছি।
বাঁশরি। পুরুষ বলেই বুঝতে পারছ না যে, ভালোবাসা নইলে দুজন মানুষকে মেলানো যায় না।
পুরন্দর। মেয়ে বলেই বুঝতে ইচ্ছা করছ না, ভালোবাসার মিলনে মোহ আছে, প্রেমের মিলনে মোহ নেই।
বাঁশরি। মোহ চাই, চাই সন্ন্যাসী, মোহ নইলে সৃষ্টি কিসের! তোমার মোহ তোমার ব্রত নিয়ে–সেই ব্রতের টানে তুমি মানুষের মনগুলো নিয়ে কেটে ছিঁড়ে জোড়াতাড়া দিতে বসেছ–বুঝতেই পারছ না তারা সজীব পদার্থ, তোমার প্ল্যানের মধ্যে খাপ-খাওয়াবার জন্য তৈরি হয় নি। আমাদের মোহ সুন্দর, আর ভয়ংকর তোমাদের মোহ।
পুরন্দর। মোহ নইলে সৃষ্টি হয় না, মোহ ভাঙলে প্রলয়, এ কথা মানতে রাজি আছি। কিন্তু, তুমিও এ কথা মনে রেখো, আমার সৃষ্টি তোমার সৃষ্টির চেয়ে অনেক উপরে। তাই আমি নির্মম হয়ে তোমার সুখ দেব ছারখার করে। আমিও চাইব না সুখ; যারা আসবে আমার কাছে সুখের দিক থেকে, মুখ দেব ফিরিয়ে। আমার ব্রতই আমার সৃষ্টি, তার যা প্রাপ্য তা তাকে দিতেই হবে। যতই কঠিন হোক।
বাঁশরি। সেইজন্যেই সজীব নয় তোমার আইডিয়া, সন্ন্যাসী। তুমি জান মন্ত্র, জান না মানুষকে। মানুষের মর্মগ্রন্থি টেনে ছিঁড়ে সেইখানে তোমার কেঠো আইডিয়ার ব্যাণ্ডেজ বেঁধে অসহ্য ব্যথার ’পরে মস্ত মস্ত বিশেষণ চাপা দিতে চাও। তাকে বল শান্তি? টিঁকবে না ব্যাণ্ডেজ্, ব্যথা যাবে থেকে। তোমরা সব অমানুষ, মানুষের বসতিতে এলে কী করতে! যাও-না তোমাদের গুহাগহ্বরে বদরিকাশ্রমে। সেখানে মনের সাধে নিজেদের শুকিয়ে পাথর করে ফেলো। আমরা সামান্য মানুষ, আমাদের তৃষ্ণার জল মুখের থেকে কেড়ে নিয়ে মরুভূমিতে ছড়িয়ে দিয়ে তাকে সাধনা বলে প্রচার করতে চাও কোন্ করুণায়! ব্যর্থজীবনের অভিশাপ লাগবে না তোমাকে? যা নিজে ভোগ করতে জান না তা ভোগ করতে দেবে না ক্ষুধিতকে?