সে

লাগছে বৈকি। একেবারে দুম্‌দাম্‌ শব্দে লাগছে।

সৃষ্টির সর্বপ্রধান পর্বে বেসুরেরই রাজত্ব, এ কথাটা বুঝতে পেরেছ তো?

বুঝিয়ে দাও - না।

তরল জলের কোমল একাধিপত্যকে ঢুঁ মেরে, গুঁতো মেরে, লাথি মেরে, কিল মেরে, ঘুষো মেরে, ধাক্কা মেরে, উঠে পড়তে লাগল ডাঙা তার পাথুরে নেড়া মুণ্ডুগুলো তুলে। ভূলোকের ইতিহাসে এইটেকেই সব চেয়ে বড়ো পর্ব বলে মান কি না।

মানি বৈকি।

এত কাল পরে বিধাতার পৌরুষ প্রকাশ পেল ডাঙায় ; পুরুষের স্বাক্ষর পড়ল সৃষ্টির শক্ত জমিতে। গোড়াতেই কী বীভৎস পালোয়ানি। কখনো আগুনে পোড়ানো, কখনো বরফে জমানো, কখনো ভূমিকম্পের জবর্দস্তির যোগে মাটিকে হাঁ করিয়ে কবিরাজি বড়ির মতো পাহাড়গুলোকে গিলিয়ে খাওয়ানো — এর মধ্যে মেয়েলি কিছু নেই, সে কথা মান কি না।

মানি বই কি।

জলে ওঠে কলধ্বনি, হাওয়ায় বাঁশি বাজে সোঁ - সোঁ — কিন্তু বিচলিত ডাঙা যখন ডাক পাড়তে থাকে তখন ভরতের সংগীত শাস্ত্রটাকে পিণ্ডি পাকিয়ে দেয়। তোমার মুখ দেখে বোধ হচ্ছে, কথাটা ভালো লাগছে না। কী ভাবছ বলেই ফেলো না।

আমি ভাবছি, আর্ট মাত্রেরই একটা পুরাগত বনেদ আছে যাকে বলে ট্র্যাডিশন। তোমার বেসুরধ্বনির আর্টকে বনেদি বলে প্রমাণ করতে পার কি।

খুব পারি। তোমাদের সুরের মূল ট্র্যাডিশন মেয়ে - দেবতার বাদ্যযন্ত্রে। যদি বেসুরের উদ্ভব খুঁজতে চাও তবে সিধে চলে যাও পৌরাণিক মেয়েমহল পেরিয়ে পুরুষদেবতা জটাধারীর দরজায়। কৈলাসে বীণাযন্ত্র বে - আইনি, ঊর্বশী সেখানে নাচের বায়না নেয় নি। যিনি সেখানে ভীষণ বেতালে তাণ্ডবনৃত্য করেন তাঁর নন্দীভৃঙ্গী ফুঁকতে থাকে শিঙে, তিনি বাজান ববম্‌বম গালবাদ্য, আর কড়াকড় কড়াকড় ডমরু। ধ্বসে পড়তে থাকে কৈলাসের পিণ্ড পিণ্ড পাথর। মহাবেসুরের আদি - উৎপত্তিটা স্পষ্ট হয়েছে তো?

হয়েছে।

মনে রেখো সুরের হার, বেসুরের জিত, এই নিয়েই পালা রচনা হয়েছে পুরাণে দক্ষযজ্ঞের। একদা যজ্ঞসভায় জমা হয়েছিলেন দেবতারা — দুই কানে কুণ্ডল, দুই বাহুতে অঙ্গদ, গলায় মণিমাল্য। কী বাহার! ঋষিমুনিদের দেহ থেকে আলো পড়ছিল ঠিক্‌‍রিয়ে। কণ্ঠ থেকে উঠছিল অনিন্দ্যসুন্দর সুরে সুমধুর সামগান, ত্রিভুবনের শরীর রোমাঞ্চিত। হঠাৎ দুড়্‌দাড়্‌ করে এসে পড়ল বিশ্রীরূপের বেসুরি দল, শুচিসুন্দরের সৌকুমার্য মুহূর্তে লণ্ডভণ্ড। কুশ্রীর কাছে সুশ্রীর হার, বেসুরের কাছে সুরের — পুরাণে এ কথা কীর্তিত হয়েছে কী আনন্দে, কী অট্টহাস্যে, অন্নদামঙ্গলের পাতা ওল্‌‌‍টালেই তা টের পাবে। এই তো দেখছ বেসুরের শাস্ত্রসম্মত ট্র্যাডিশন। ঐ - যে তুন্দিলতনু গজানন সর্বাগ্রে পেয়ে থাকেন পুজো, এটাই তো চোখ - ভোলানো দুর্বল ললিতকলার বিরুদ্ধে স্থূলতম প্রোটেস্‌ট্‌। বর্তমান যুগে ঐ গণেশের শুঁড়ই তো চিম্‌‍নি - মূর্তি ধরে পাশ্চাত্য পণ্যযজ্ঞশালায় বৃংহিতধ্বনি করছে। গণনায়কের এই কুৎসিত বেসুরের জোরেই কি ওরা সিদ্ধিলাভ করছে না। চিন্তা করে দেখো।

দেখব।

যখন করবে তখন এ কথাটাও ভেবে দেখো, বেসুরের অজেয় মাহাত্ম্য কঠিন ডাঙাতেই। সিংহ বলো, ব্যাঘ্র বলো, বলদ বলো, যাদের সঙ্গে সগর্বে বীরপুরুষদের তুলনা করা হয় তারা কোনো কালে ওস্তাদজির কাছে গলা সাধে নি। এ কথায় তোমার সন্দেহ আছে কি।

তিলমাত্র না।