ব্যক্তি প্রসঙ্গ
জগদিন্দ্রনাথের তাহা অজস্র ছিল, তাহার সঙ্গে ছিল আধুনিক যুগের শিক্ষা। জগদিন্দ্রনাথের চিত্তবিকাশে দুইটি বিদ্যার ধারার সমান মিলন দেখিয়াছি। সংস্কৃত শাস্ত্র ও সাহিত্যে তাঁহার যেমন গভীর আনন্দ ছিল, ইংরেজি সাহিত্যেও তাঁহার তেমনি ছিল অধিকার। এই অধিকার বাহিরের শিক্ষায় নহে অন্তরের ধারণাশক্তিতে। তাঁহার চিত্তরাজ্যে যাহা আমাদের মনকে সব চেয়ে আকর্ষণ করিয়াছিল, তাহা পাণ্ডিত্যের উপাদান নহে, তাহা সহজ সহৃদয়তায় প্রদীপ্ত রুচির আলোক।

সংসারে সাধারণ আদর্শমতো ভালো লোক অনেকে আছেন, কিন্তু তাঁহাদিগকে মনে রাখিতে পারি না। তাঁহারা যেন গুণের তালিকা মাত্র। যে অলক্ষ্য সূত্রে সেই গুণগুলিকে এক করিয়া মানুষের ব্যক্তিস্বরূপটিকে পরিস্ফুট করিয়া তুলে, জগদিন্দ্রনাথের মধ্যে তাহাই ছিল। এইজন্য যখন তিনি ইহলোক হইতে চলিয়া গেলেন, বন্ধুদের স্মৃতিলোকে তাঁহার মূর্তি অম্লান ভাবে প্রতিষ্ঠিত রহিল।

লর্ড সিংহ

অন্তরের দিক থেকে সব মানুষকে দেখবার সুযোগ ঘটে ওঠে না। সে-অবস্থায় মানুষটি বড়ো কি ছোটো বিচার করি মতের মিলের মাপকাঠি দিয়ে। যার সঙ্গে আমাদের মতের অনৈক্য তার সম্বন্ধে আমাদের মন কৃপণ। দলের লোককে পুরস্কার দেওয়া আমাদের পক্ষে সহজ, কেননা সে পুরস্কারের অনেকখানি নিজের উপর এসে পৌঁছয়।

অন্তরের দিক থেকে সব মানুষকে যে আমরা দেখতে পাই নে তার প্রধান কারণ এ নয় যে, কাউকে কাছে থেকে দেখবার অবকাশ সাধারণত ঘটে না। অনেক ক্ষেত্রেই অন্তরের মানুষটি দেখবার মতো মানুষ নয়। দলের মধ্যে যে মানুষ কোনো প্রধান স্থান পেয়েছে সমস্ত দলের কাঁধের উপর চড়ে সে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কিন্তু অন্তরের মানুষ একা, যদি সে আপন মহিমাতেই দেখা দিল তবেই তাকে দেখা যায়। সেই পরিচয়ে কেবলমাত্র দলের লোকের চেয়েও তাকে অনেক বেশি সত্য বলে জানি, আত্মীয় বলে জানি।

লর্ড সিংহকে দৈবক্রমে কিছুদিন নিয়ত কাছে দেখতে পেয়েছি। গতবারে য়ুরোপ মহাদেশ ভ্রমণ করবার সময় তাঁর সঙ্গলাভ করবার সুযোগ ঘটেছিল। ইংলণ্ড থেকে আমরা একত্র যাত্রা করেছি নরোয়েতে। তিন দিন লেগেছিল পাড়ি দিতে—এই তিন দিন ধরে উত্তর সমুদ্র ঝড়ে তোলপাড়। ছোটো জাহাজের ঝাঁকানি একেবারে অসহ্য, শোওয়া বসা দাঁড়ানো সমস্তই দুঃসাধ্য। ক্যাবিন থেকে এক মুহূর্ত বাইরে বেরোতে আমার সাহস হয় নি। সেই সময়ে প্রতিদিন প্রসন্নমুখে তিনি আমার খবর নিয়েছেন। কাজটা একটুমাত্র সহজ ছিল না—চলতে গিয়ে তিনি সিঁড়ির উপর আছাড় খেয়েছেন, তবু এই কঠিন দুর্যোগে বিশেষ কষ্ট করে তিনি যে দেখা দিয়ে যেতেন সে তাঁর অকৃত্রিম সহৃদয়তার গুণে। সকল অবস্থাতেই তাঁর মধ্যে যে সৌজন্য দেখেছি সে আচারগত নয়, সে হৃদয়গত। এই কারণে এই সৌজন্য তাঁর একটি শক্তির অঙ্গ ছিল। এই শক্তিতে তিনি সহজে সর্বত্র প্রবেশাধিকার পেতেন। কয়েকদিনের মধ্যেই দেখতে পেলেম নরোয়েতে যাঁদের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হল সে পরিচয়ে অনায়াসে তিনি তাঁদের হৃদ্যতা লাভ করলেন—এই জিনিসটি সম্মানলাভের চেয়েও দুর্লভ। তিনি যে পদবী পেয়েছিলেন য়ুরোপীয় সমাজে সে পদবীর মূল্য যথেষ্ট বেশি। কিন্তু ওই পদবীর আড়ম্বর করতে তাঁকে একদিনও দেখি নি। আমরা একত্রে সুইডেন, ডেনমার্ক, জার্মানি ভ্রমণ করেছি, কিন্তু এই পদবী-গৌরবের লেশমাত্র চাঞ্চল্য, এই পদবীটাকে প্রত্যক্ষ করিয়ে সকলের অগ্রসর হয়ে চলবার চেষ্টা আমি কোথাও তাঁর মধ্যে একদিনের জন্যও অনুভব করি নি। যে আভিজাত্যের অভাবনীয় অধিকার তিনি পেয়েছিলেন সেই অধিকার যেন তাঁর নূতন পাওয়া সামগ্রী নয়, সে যেন তাঁর সহজাত। তাতে করে তাঁর স্বাভাবিক নম্রতাকে একটুমাত্র আবৃত করে নি। এর থেকে একটি জিনিস স্পষ্ট বুঝতে পেরেছিলুম, লর্ড সিংহ আপন স্বভাবে অত্যন্ত সত্য ছিলেন। বাইরের কিছুতেই এর থেকে তাঁকে বিচলিত করতে পারে নি। দশের অনুবৃত্তি করা, ভিড়ের ঠেলায় চলা তাঁর পক্ষে অসম্ভব ছিল। এই কারণেই তাঁর মধ্যে সম্মানের চাঞ্চল্য দেখি নি, এই কারণেই লোকমুখের