পরিশিষ্ট
তুলসীদাস
তুলসীদাসের স্মৃতিবাসরে আজকে তোমরা আমাকে সভাপতিরূপে বরণ করেছ— তুলসীদাসের সাহিত্যের সঙ্গে আমি বিশেষভাবে পরিচিত নই, সুতরাং সে বিষয়ে বিশেষ কিছু বলা আমার দ্বারা সম্ভব হয়ে উঠবে না। নৌকোর ধ্বজা তার গৌরব বৃদ্ধি করবার জন্য, যাত্রার সময়ে ধ্বজা তাকে সহায়তা করে না। আমি কেবলমাত্র তেমনি তোমাদের স্মৃতিবাসরে গৌরব বৃদ্ধিই করতে পারব— তুলসীদাসকে জানবার সহায়তা করতে পারব না।

ছোটো ছোটো কবিরা জন্মগ্রহণ ক’রে ভাষার গাঁথুনিকে ধীরে ধীরে শক্ত করে বেঁধে তোলে, সাহিত্যকে উন্নতির দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। সাহিত্য তাদের শক্তিসঞ্চারে যে-পরিমাণে পরিপুষ্টিলাভ করে তা দেশের জনসাধারনের কাছে ধরা পড়ে না। বড়ো কবিরা যখন তাঁদের অপূর্ব শক্তি নিয়ে অসাধারণ প্রতিভা নিয়ে জন্মগ্রহণ করেন মহীরূপ বনস্পতির মতো তখন তাঁদের কাব্যের মূল পৌঁ/ছায় দেশের অন্তস্তলে।সমগ্র দেশকে তাঁরা রস পরিবেশন করে থাকেন; তাঁদের কর্মকুশলতা ভাষাকে নতুন ক’রে গড়ে তোলে, চিন্তা করবার প্রনালীকে নতুন রূপ দেয়, মানুষের চিত্তকে উদ্‌বোধিত করে নতুন প্রেরণায়।

তুলসীদাস তাঁর ‘রামচরিতে’র উপকরণ সংগ্রহ করেছিলেন বাল্মীকির রচনা থেকে; কিন্তু সেই উপকরণকে তিনি সম্পূর্ণ নিজের ভক্তিতে রসসমৃদ্ধ করে নতুন করে দান করেছেন। সেইটেই তাঁর নিজস্ব দান— পুরাতনের আবৃত্তি নয়, তাতে তাঁর যথার্থ প্রতিভার প্রকাশ পেয়েছে। তিনি নতুন দৃষ্টি নিয়ে সেই পুরাতন উপকরণকে নতুন রূপ দান করে পরিবেশন করেছেন সমস্ত দেশকে। ভক্তিদ্বারা যে ব্যাখ্যায় তিনি রামায়ণকে নতুন পরিণতি দিয়েছেন সেটা সাহিত্যে অসাধারণ দান।

বর্তমানে ইংরেজি সাহিত্যের প্রভাব সর্বত্র বিস্তৃতি লাভ করছে, মানুষের রুচিতে পরিবর্তন এসেছে। তবু তুলসীদাসের দান যুগকে সম্পূর্ণভাবে অধিকার করে আছে। এই-যে সমস্ত কালকে অধিকার করা— এ সৌভাগ্য অল্পলোকেরই হয়। হিন্দীসাহিত্যে তুলসীদাসের দানকে সকলের চেয়ে বড় বলে গণ্য করা হয়েছে এবং চিরকাল তাঁর সে গৌরব অক্ষুন্ন থাকবে। তাঁর রচনা হিন্দী সাহিত্যে স্রোত বইয়ে দিয়েছে— পরিবর্তনের পথে নতুন গতিদান করেছে— হিন্দী ভাষার গৌরব বাড়িয়েছে। অনুভবে এর সত্যতা আমাদের কাছে সহজেই ধরা পড়ে। আজ পর্যন্ত সেই স্রোত বিশিষ্ট পথ রচনা করে আধুনিক হিন্দী সাহিত্যে বয়ে চলে এসেছে।

আমার মনে পড়ে বাল্যকালে প্রতি সন্ধ্যায় আমাদের বাড়ির দারোয়ানরা তুলসীদাসের রামায়ণ গান করত। তারা সেই গান থেকে যেন অমৃতলাভ করে সমস্ত দিনের ক্লান্তি দূর করত— তাদের অবসর সময়কে রসময় করে তুলত। তাদের ভিতর দিয়ে আমি সর্বপ্রথম তুলসীদাসের প্রতিভার পরিচয় পেয়েছি।

বর্তমানে বাংলা এবং হিন্দী-সাহিত্যে নতুন কাল এসেছে। সমস্ত পরিবর্তিত হতে চলেছে— আমাদের চিত্তের গতি বদলে গিয়েছে কালের প্রভাবে— মানুষের কাব্যরুচিকেও সে-গতি দিয়েছে বদলে। য়ুরোপের সাহিত্যে আমাদের দেশের সাহিত্যকে এক নতুন পন্থায় নিয়ে গেছে— নতুন বিকাশের পথ খুঁজে দিয়েছে। তবু এ কথাও ভুললে চলবে না— যাঁদের শিক্ষিত বলি তাঁদের প্রভাব অতি সামান্য, জনসাধারণের চিত্ত হচ্ছে দেশের যথার্থ ভূমি; যেখানে স্বভাবত প্রকৃতির প্রেরণায় ফসল ফলে সে হচ্ছে সর্বজনের চিত্তক্ষেত্র। সে-ক্ষেত্রে যথার্থ সৃষ্টির অধিকারের পথে য়ুরোপীয় সাহিত্যের প্রভাব ব্যাঘাত জন্মাতে পারবে না। দেশের সেই সর্বজনের চিত্তক্ষেত্র থেকে তুলসীদাসের অধিকার কোনো কালেই যাবে না। তাঁর দান স্থায়ী মহান প্রতিভার বিকাশ নিয়ে কালের প্রভাবকে অতিক্রম করে চিরকাল দেশকে সমৃদ্ধ করবে।

রচনাকাল শ্রাবণ ১৩৪৭