ব্যক্তি প্রসঙ্গ
ছিলেন। আমি ছিলাম স্বভাবতই বড়ো বেশি আধুনিক, বিদ্রোহী বলিলেই হয়। গানের নামে আমি রাগ-রাগিণী ও বাঁধা তালের ছাঁচে ঢালা নমুনা দেখাইবার দিকে মন দিই নাই—এমন অবস্থাতেও জগদিন্দ্রনাথ গান সম্বন্ধে আমাকে একঘরে করিলেন না। আমার গান তাঁহার শিক্ষা ও অভ্যাসের বিরুদ্ধ হইলেও তাঁহার রুচিবিরুদ্ধ হয় নাই। তিনি অকৃত্রিম আনন্দের সহিত তাহার রস উপভোগ করিতেন। কি সাহিত্যে কি সংগীতে তাঁহার মনের মধ্যে ভারি একটি দরদ ছিল—বাঁধা দস্তুরের শিক্ষা কস্‌রতে তাহার কোনো অংশে একটুও কড়া পড়িয়া যায় নাই। তাই খামখেয়ালির আসরে তিনি আপন আসনটি এমন পুরাপুরি দখল করিতে পারিয়াছিলেন। সে সময়ে আমার নিজের নির্জন আসন ছিল পদ্মাতীরে বালুতটে। সেখানেও কিছুদিন তাঁহাকে অতিথি পাইয়াছিলাম। যাহারা সভাচর জাতীয় সামাজিক, তাহাদের পক্ষে পদ্মাতীরের সঙ্গবিরলতা অত্যন্ত শূন্য ঠেকিবার কথা; কিন্তু জগদিন্দ্র সেখানকার নিভৃত প্রকৃতির আমন্ত্রণ হইতে বঞ্চিত হন নাই; সেখানকার জল স্থল আকাশের সুরের সঙ্গে তাঁহার মনের মধ্যে সঙ্গৎ জমিয়াছিল, তাল কাটে নাই।

জগদিন্দ্রনাথ আমার এই নির্জন আতিথ্যের জবাব দিয়াছিলেন বিশাল জনসংঘের মধ্যে। যে বৎসর নাটোরে প্রাদেশিক রাষ্ট্রীয় সম্মিলনীর সভা বসিল, সেবার তাঁহার আহ্বানে খামখেয়ালির প্রায় সকলেই তাঁহার ঘরে গিয়া জড়ো হইল। স্বভাবদোষে সেখানেও বিদ্রোহের হাওয়া তুলিয়াছিলাম, জগদিন্দ্র হইয়াছিলেন তাহার সহায়। তখন প্রাদেশিক সম্মিলনীতে বক্তৃতাদি হইত ইংরেজি ভাষায়—অনেকদিন হইতে আমার কাছে তাহা একই কালে হাস্যকর ও দুঃখকর ঠেকিত। এবার নিরন্তর উৎপাত করিয়া আমরা এই অদ্ভুত কদাচার ভাঙিয়া দিয়াছিলাম। তাহাতে প্রবীণ দেশহিতৈষীর দল আমার উপর বিষম বিরক্ত হইয়াছিলেন। তাঁহাদের সেই রুদ্রতায় যে কৌতুক ফেনিল হইয়া উঠিয়াছিল তাহার মধ্যে জগদিন্দ্রনাথের হাস্য প্রচুর পরিমাণে ছিল।

সেবারে সব চেয়ে যাহা আমরা উপভোগ করিয়াছিলাম, সে তাঁহার আতিথ্যের আয়োজন নহে, আতিথ্যের রস। সেই বিরাট যজ্ঞে উপকরণের বাহুল্যই হইয়াছিল, কিন্তু সেটা বড়ো কথা নহে। এত বৃহৎ জনতার মধ্যে তাঁহার সঙ্গ তাঁহার সৌজন্য যে কেমন করিয়া সর্বব্যাপী হইয়া বিরাজ করিত, তাহাই আমার কাছে বিস্ময়ের বিষয়। আমাদের দেশে যজ্ঞকর্তার অবস্থা যে কিরূপ শোচনীয়, তাহা বাঙালি বরযাত্রীদের মেজাজ আলোচনা করিলেই বুঝা যায়। সময় অসময় সম্ভব অসম্ভবের বিচার নাই, সমস্ত ক্ষণ আবদার অভিযোগ অভিমানের তুফান তুলিবার চেষ্টা। সর্বজনীন কর্মানুষ্ঠানে সকল দলেরই যে সম্মিলিত দায়িত্ব সে কথা মনে থাকে না; নিমন্ত্রিতেরা যেন নিমন্ত্রণ কর্তার প্রতিপক্ষ, তাহাকে হয়রান করিয়া তুলিতে যেন বাহাদুরী আছে, লজ্জা মাত্র নাই। সেবারেও সেইরূপ বরযাত্র মেজাজের লোকের অভাব ছিল না। কিন্তু জগদিন্দ্রনাথ দিনে রাতে অনুনয় বিনয়ে সেই-সকল উত্তেজিত অতিথি-অভ্যাগতের অহৈতুক প্রকোপ প্রশমনের জন্য প্রস্তুত ছিলেন। অযোগ্য ব্যক্তিদের কর্তৃক অন্যায় রূপে লাঞ্ছিত হইয়াও মুহূর্তকালের জন্য তাঁহার প্রসন্নতা দূর হয় নাই। সভাধিবেশনের দ্বিতীয় দিনে আর-এক অত্যাচারকারী অনাহূত অতিথির অকস্মাৎ আবির্ভাবে সকলের চমক লাগিল, সে আর কেহ নহে সেই বছরের ভূমিকম্প। সভা ভাঙিয়া গেল, পৃথিবীর শ্যামল গাত্রাবরণখানাকে কোন্‌ দৈত্য নখ দিয়া ছিঁড়িতে লাগিল, দালান ফাটিল—চারি দিকেই বিভীষিকা। বিঘ্ন বিপদ যাহা ঘটিবার তাহা তো ঘটিল, তাহার চেয়েও প্রবলতর পীড়া বাধাইল অনিশ্চিতের আশঙ্কা। রেলপথ বন্ধ, তারে খবর চলে না, অতিথিগণ সকলেই ঘরের খবরের জন্য উদ্‌বিগ্ন। দুর্দৈবের বড়ো ধাক্কাটা যখন থামিয়াছে তখনো ক্ষণে ক্ষণে ধরণীর হৃৎকম্প থামে না। পাকা কোঠায় থাকিতে কাহারো সাহস হয় না, চালা ঘরে কোনো প্রকারে সকলের গোঁজামিলন। যিনি গৃহস্বামী এই দুর্বিপাকে নিঃসন্দেহই নিজের সংসারের জন্য তাঁহার উদ্‌বেগের সীমা ছিল না। কিন্তু নিজের ক্ষতি ও বিপত্তির চিন্তা তাঁহার মনের মধ্যে যে আলোড়িত হইতেছিল বাহির হইতে তাহা কে বুঝিবে? বিধাতা তাঁহার আতিথেয়তার যে কী কঠিন পরীক্ষা করিয়াছিলেন তাহা আমরা জানি, আর সেই পরীক্ষায় তিনি যে কিরূপ সগৌরবে উত্তীর্ণ হইয়াছিলেন তাহাও আমাদের মনে পড়ে।

যে সৌজন্য, যে বৈদগ্ধ্য, যে আত্মমর্যাদাবোধ, যে সামাজিক আত্মোৎসর্গ আমাদের দেশের প্রাচীন অভিজাত বংশীয়ের উপযুক্ত,