ব্যক্তি প্রসঙ্গ
বাহবাতেও তিনি অলুব্ধ ছিলেন।

স্বভাবে তাঁর এই যে প্রতিষ্ঠা এর মধ্যে অন্ধ জেদের রূপ ছিল না, তার কারণ তাঁর বুদ্ধির অসামান্য স্বচ্ছতা। বরাবর নিজের পথ তিনি বিচার করেই স্থির করেছিলেন, ঝোঁকের মাথায় করেন নি। যে কয়দিন একত্রে ছিলাম, তাঁর সঙ্গে নানা বিষয়ে আলোচনা করবার অবকাশ ঘটেছিল। এইসব আলোচনায় যেটা আমি বিশেষ করে লক্ষ্য করেছি সে হচ্ছে তাঁর চিত্তের শান্ত ভাব। তিনি যা বুঝতেন বুদ্ধির আলোকে সে তিনি স্পষ্ট করে বুঝতেন, এইজন্যে তার মধ্যে তাঁর এমন শান্তি ছিল। গোঁড়ামির মধ্যে এ শান্তি থাকে না। তাঁর চিন্তার মধ্যে এই অনুদ্ধত শান্তি থাকাতেই আলোচনাকালে তাঁর মতকে স্বীকার করে নেওয়া সহজ ছিল। জেদ ও গোঁড়ামির বন্ধুরতা যেখানে নেই, সেখানে এক মনের সঙ্গে আর-এক মনের চিন্তা চলাচলের পথ সুগম হয় মতের অমিল থাকলেও।

তাঁর সঙ্গে ভ্রমণকালে বার বার আমার এই কথাটি মনে হয়েছে, যে, তিনি তাঁর নাম সার্থক করেছেন, সত্য এবং প্রসন্নতা এই দুইই তাঁর ছিল স্বভাবসিদ্ধ। তাঁর বুদ্ধির ’পরে তাঁর সত্যের ’পরে এবং তাঁর সৌহার্দ্যের ’পরে সম্পূর্ণ নির্ভর করা যেত; এই গুণেই সংসারে তিনি বড়ো হতে পেরেছেন, বড়ো হবার জন্যে তাঁকে কোনো কৌশল করতে হয় নি। লর্ড সিংহের মৃত্যুতে ব্যক্তিগতভাবে আমাকে যে বেদনা লেগেছে তার একটা কারণ এই যে, কিছুদিনের নিয়ত সঙ্গলাভের মধ্য দিয়ে আমি তাঁর আত্মীয়তা পেয়েছি। আরো একটি কারণ আছে।

আমাদের গ্রামগুলির জীর্ণতা সংস্কার করে তাদের মধ্যে প্রাণ সঞ্চার করতে পারলে তবে আমাদের দেশকে বাঁচাতে পারা যাবে, এই কথাটি মনে রেখে দীর্ঘকাল থেকে আমার সাধ্যানুসারে কিছু কিছু কাজ করবার চেষ্টা করেছি। এই কাজে আমার স্বদেশের লোকের মধ্যে যে দুই-এক জনের সহায়তা পেয়েছি তার মধ্যে লর্ড সিংহ ছিলেন সর্বপ্রধান। তাঁর এই সহয়তা ছিল অপ্রগল্‌ভ, কিন্তু সকল প্রকারেই খুব খাঁটি। এই কাজ সম্বন্ধে যথার্থ তাঁর আস্থা ছিল—সে কেবল দেশের প্রতি তাঁর প্রেমবশত, লোকরঞ্জনের জন্যে নয়। এ ব্যাপারে আমার সঙ্গে তাঁর সহযোগিতার সূত্রপাত হয়েছিল। সেই সূত্র অকস্মাৎ ছিন্ন হয়ে গেল। ভাগ্যের কার্পণ্যফলে দৈবাৎ আমরা অতি অল্পই পেয়ে থাকি; এইজন্যে যে বন্ধুকে হারাই তাঁর ক্ষতিপূরণের ভরসা মনে থাকে না। সেই দুঃখের মধ্যে আজ কেবল তাঁর সঙ্গে আমার সৌহৃদ্যের সম্বন্ধ ও আমার সংকল্পে তাঁর সমর্থন ও সহযোগিতার গৌরব স্বীকার করে এই কয়েকটি ছত্র তাঁর উদ্দেশে উৎসর্গ করে দিলাম। ৭ই চৈত্র, ১৩৩৪

. উমা দেবী

বীণার তার হঠাৎ ছিঁড়ে গিয়ে গান যদি অকালে স্তব্ধ হয়ে যায় তবে তার অন্তঃপ্রবাহ শ্রোতার মনে নীরবে সমাপ্তির মুখে চলতে থাকে; উমার অসম্পূর্ণ জীবন তেমনি করে অকালমৃত্যুর মধ্যে দিয়ে তার প্রিয়জনদের মনের মধ্যে একটি অন্তরতর গতি লাভ করেছে। সংসারে স্নেহ দেবার এবং স্নেহ পাবার ইচ্ছা তার জীবনে সব চেয়ে একান্ত ছিল। ফুল যেমন আলো চায় এবং গন্ধ দেয়, সে তার অল্পায়ু জীবলীলায় তেম্‌নি করেই প্রীতি দিয়েছে এবং নিয়েছে। সেই দেওয়া নেওয়ার অবসান হল এমন কথা মনে করে যেন বিলাপ না করি। জীবিতকালেই সে অনুভব করেছিল যে, তার স্পর্শশক্তি মৃত্যুর অন্তরাল অতিক্রম করেছে; আজ শ্রদ্ধার সঙ্গে যেন মনে করি যে তার আত্মিক শক্তি ইহলোক পরলোকের মাঝখানে আত্মীয়তার সেতু রচনা করে আছে এবং আত্মীয় বন্ধুদের কাছ থেকে শোকস্মৃতির অর্ঘ্য গ্রহণ ক’রে এই মুহূর্তেই তার হৃদয় স্নিগ্ধ হল। তার আত্মা শান্তিলাভ করুক, তৃপ্তিলাভ করুক, মর্ত্য জীবনের সমস্ত অপূর্ণতা থেকে মুক্তিলাভ করুক, এই কামনা করি।