ব্যক্তি প্রসঙ্গ

সাধারণত আমরা যখন খাঁটি বাঙালির মেয়ের আদর্শ খুঁজি তখন গৃহকোণচারিণীর ’পরেই আমাদের দৃষ্টি পড়ে। গৃহসীমানার মধ্যে আবদ্ধ যে সংকুচিত জীবন তাহারই সংকীর্ণ আদর্শের বহুবেষ্টনরক্ষিত উৎকর্ষ দুর্লভ পদার্থ নহে। তাহার উপাদান অথবা, তাহার ক্ষেত্র অপ্রশস্ত, তাহার পরীক্ষা অপেক্ষাকৃত অকঠোর।

সরোজনলিনী বাহির সংসারের ভিড়ের মধ্যেই অধিকাংশ জীবন কাটাইয়াছেন, অনেক সময় বিদেশী সমাজের অতিথি বন্ধুদের লইয়া তাঁহাকে সামাজিকতা করিতে হইয়াছে, তাঁহার কর্মজীবনের পরিধি আত্মীয়স্বজন বন্ধুমণ্ডলীর মধ্যেই অবরুদ্ধ ছিল না; তাঁহার সংসার আত্মীয় অনাত্মীয়, স্বদেশী বিদেশী, পরিচিত অপরিচিত অনেক লোককে লইয়া। এই তাঁর বড়ো সংসারের মধ্যে সকলের সঙ্গে সম্বন্ধকে তিনি মাধুর্যের দ্বারা শোভন ও ত্যাগের দ্বারা কল্যাণময় করিয়াছিলেন। এইরূপ ক্ষেত্রেই নারী জীবনের যথার্থ পরিচয় ও পরীক্ষা। তাঁহার কাছে বাহিরের দ্বারা ঘর ও ঘরের দ্বারা বাহির পরাহত হয় নাই। এই উভয়ের সুন্দর সমন্বয়েই তাঁহার মহিমা প্রকাশিত হইয়াছে। আজকালকার দিনে নারী একান্তভাবেই গৃহিণী তিনি আমাদের আদর্শ নহেন, ঘরে বাহিরে সর্বত্রই যিনি কল্যাণী তিনিই আদর্শ, যাঁহার জীবন কেবলমাত্র চিরাগত প্রাদেশিক প্রথা ও সংস্কারের ছাঁচে ঢালা তিনি আদর্শ নহেন কিন্তু যাঁহার মধ্যে বৃহৎ বিশ্বের জ্ঞান ও ভাবের বিচিত্র ধারা গভীর ও সুন্দরভাবে সংগতি লাভ করিতে বাধা না পায় তিনিই আদর্শ।

সরোজনলিনীর জীবনী পড়িয়া আমরা এই আদর্শের পরিচয় পাইলাম।

জগদিন্দ্র-বিয়োগে

সংসারে পরিচয় হয় অনেকেরই সঙ্গে, কিন্তু অধিকাংশ স্থলেই সেই পরিচয়ের কোঠা পার হইয়া ভিতরের মহলে প্রবেশ করা ঘটিয়া উঠে না। সহজে আত্মীয়তা করিবার শক্তি দুর্লভ শক্তি, জগদিন্দ্রনাথের সেই শক্তি ছিল। শ্রদ্ধা অনেক লোককে করা যায়, অসামান্য গুণের জন্য অনেককে প্রশংসাও করিয়া থাকি কিন্তু তবু আপন বলিয়া মানিতে পারি না। মৃত্যুর আকস্মিক আঘাতে যে বন্ধুকে আজ হারাইয়াছি, তাঁহার সম্বন্ধে এই কথাটাই মনে সবচেয়ে বড়ো করিয়া জাগিয়া উঠিতেছে যে, প্রথম পরিচয় হইতেই আত্মীয় হইয়া উঠিতে তাঁহার বিলম্ব হয় নাই, এবং সম্পূর্ণই সে তাঁহার নিজগুণে। তখন লোকেন্দ্রনাথ পালিত ছিলেন রাজসাহির ম্যাজিস্ট্রেট, আমি তাঁহার অতিথি। তখন সাধনা পত্রিকার ঝুলি প্রতিমাসেই আমাকে নানাবিধ রচনা দিয়া ভরিয়া দিতে হইত। ম্যাজিস্ট্রেটের নির্জন বাংলায় আমার সমস্ত দিন সেই কাজেই পূর্ণ ছিল। লোকেন কাছারি হইতে ফিরিলে পর সন্ধ্যার সময় বৈঠক বসিত। সেই বৈঠকে আভিজাত্যের লাবণ্যে উদ্ভাসিতমূর্তি যুবক জগদিন্দ্রনাথ প্রধান ব্যক্তি ছিলেন। তাঁহাকে প্রধান যে বলিলাম সেটা নিজের প্রতি কপট বিনয় করিয়া নহে। নিকুঞ্জে বসন্ত উৎসবের যে আসর বসে, সে আসরের প্রধান নায়ক পুষ্পিত শাখা নহে, দক্ষিণ সমীরণ। জগদিন্দ্রনাথের চিত্তের মধ্যে চিরপ্রবাহিত যে দাক্ষিণ্য ছিল তাহারই স্পর্শে আমাদের মন ভরিয়া উঠিত। সে বৈঠকে আমরা দিতাম উপকরণ তিনি দিতেন নিজেকে। তিনিই সভা জমাইতেন। মনে পড়ে, কবিতা পড়িয়া, গান গাহিয়া, গল্প শুনাইয়া রাত্রি প্রায় শেষ হইয়া গেছে। এই অক্লান্ত মজলিশের উৎসাহ তিনিই জোগাইয়াছেন। তাঁহার রসবোধের প্রচুর আনন্দই রসের ধারাকে আকর্ষণ করিয়া আনিত। আমি তখন যৌবনের সীমা পার হই নাই, রচনার ঔৎসুক্যে আমার মন তখন পুলকিত, সেই সময়ে এই রসরাগরঞ্জিত যুবকের সহিত আমার প্রথম পরিচয়।

তার পর নাটোর হইতে যখন তিনি কলকাতায় আসিয়া বসিলেন, তখন তাঁহারই অনুপ্রাণনায় কলিকাতায় আমাদের বাড়িতে সপ্তাহে সপ্তাহে এক সান্ধ্য বৈঠক জমিয়া উঠিল, তাহার নাম ছিল “খাম খেয়ালি”। তখন আমি আপন খেয়ালমতো সুরে লয়ে গান রচিতে প্রবৃত্ত ছিলাম। আমাদের দেশে যাহাকে ক্লাসিকাল সংগীত বলা যাইতে পারে, সেই হিন্দুস্থানী সুরে তালে জগদিন্দ্রনাথ পারদর্শী