চিরকুমার-সভা

শৈলবালা। রোজ সন্ধেবেলায় যদি এইরকম উৎ পাত করেন তা হলে মাপ করব, নইলে নয়।

শ্রীশ। আচ্ছা রাজি, কিন্তু এর পরে যখন অনুতাপ উপস্থিত হবে তখন প্রতিজ্ঞা স্মরণ করবেন।

শৈলবালা। আমার জন্যে ভাববেন না, কিন্তু আপনার যদি অনুতাপ উপস্থিত হয় তা হলে আপনাকে নিষ্কৃতি দেব।

শ্রীশ। সেই ভরসায় যদি থাকেন তা হলে অনন্তকাল অপেক্ষা করতে হবে।

শৈলবালা। রসিকদাদা, তুমি শ্রীশবাবুর পকেটের দিকে হাত বাড়াচ্ছ কেন। বুড়ো বয়সে গাঁটকাটা ব্যাবসা ধরবে নাকি।

রসিক। না ভাই, সে ব্যাবসা তোদের বয়সেই শোভা পায়। একখানা রুমাল নিয়ে শ্রীশবাবুতে আমাতে তক্‌‍রার চলছে,তোকে তার মীমাংসা করে দিতে হবে।

শৈলবালা। কিরকম।

রসিক। প্রেমের বাজারে বড়ো মহাজনি করবার মূলধন আমার নেই। আমি খুচরো মালের কারবারী — রুমালটা, চুলের দড়িটা, ছেঁড়া কাগজে দু - চারটে হাতের অক্ষর, এই-সমস্ত কুড়িয়ে-বাড়িয়ে আমাকে সন্তুষ্ট থাকতে হয়। শ্রীশবাবুর যেরকম মূলধন আছে তাতে উনি বাজার - সুদ্ধ পাইকেরি দরে কিনে নিতে পারেন — রুমাল কেন, সমস্ত নীলাঞ্চলে অর্ধেক ভাগ বসাতে পারেন। আমরা যেখানে চুলের দড়ি গলায় জড়িয়ে মরতে ইচ্ছে করি উনি যে সেখানে আগুল্‌ফবিলম্বিত চিকুররাশির সুগন্ধ ঘনান্ধকারের মধ্যে সম্পূর্ণ অস্ত যেতে পারেন। উনি উঞ্ছবৃত্তি করতে আসেন কেন।

শ্রীশ। অবলাকান্তবাবু, আপনি তো নিরপেক্ষ ব্যক্তি, রুমালখানা এখন আপনার হাতেই থাক্‌, উভয় পক্ষের বক্তৃতা শেষ হয়ে গেলে বিচারে যার প্রাপ্য হয় তাকেই দেবেন।

শৈলবালা। ( রুমালখানি পকেটে পুরিয়া ) আমাকে আপনি নিরপেক্ষ লোক মনে করছেন বুঝি? এই কোণে যেমন একটি ‘ন' অক্ষর লাল সুতোয় সেলাই করা আছে আমার হৃদয়ের একটি কোণে খুঁজলে দেখতে পাবেন ঐ অক্ষরটি রক্তের বর্ণে লেখা। এ রুমাল আমি আপনাদের কাউকেই দেব না।

শ্রীশ। রসিকবাবু, এ কী রকম জবরদস্তি। আর, ‘ ন' অক্ষরটিও তো বড়ো ভয়ানক অক্ষর।

রসিক। শুনেছি বিলিতি শাস্ত্রে ন্যায়ধর্মও অন্ধ, ভালোবাসাও অন্ধ। এখন দুই অন্ধে লড়াই হোক, যার বল বেশি তারই জিত হবে।

শৈলবালা। শ্রীশবাবু, যার রুমাল আপনি তো তাকে দেখেন নি, তবে কেন কেবলমাত্র কল্পনার উপর নির্ভর করে ঝগড়া করছেন।

শ্রীশ। দেখি নি কে বললে।

শৈলবালা। দেখেছেন? কাকে দেখলেন। ‘ন' তো দুটি আছে —

শ্রীশ। দুটিই দেখেছি — তা, এ রুমাল দুজনের যাঁরই হোক, দাবি আমি পরিত্যাগ করতে পারব না।

রসিক। শ্রীশবাবু, বৃদ্ধের পরামর্শ শুনুন, হৃদয়গগনে দুই চন্দ্রের আয়োজন করবেন না ; একশ্চন্দ্রস্তমোহন্তি।


ভৃত্যের প্রবেশ

ভৃত্য। ( শ্রীশের প্রতি ) চন্দ্রবাবুর চিঠি নিয়ে একটি লোক আপনার বাড়ি খুঁজে শেষকালে এখানে এসেছে।

শ্রীশ। ( চিঠি পড়িয়া ) একটু অপেক্ষা করবেন? চন্দ্রবাবুর বাড়ি কাছেই — আমি একবার চট করে দেখা করে আসব।

শৈলবালা। পালাবেন না তো?