চিরকুমার-সভা
চাচ্ছে, ‘ ন'য়ের মালা গেঁথে একটি নীলোৎপলনয়নার গলায় পরিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে — নির্মলনবনীনিন্দিতনবীন — বলুন - না শ্রীশবাবু, শেষ করে দিন - না —

শ্রীশ। নবমল্লিকা।

রসিক। বেশ বেশ — নির্মলনবনীনিন্দিতনবীননবমল্লিকা। গীতগোবিন্দ মাটি হল। আরো অনেকগুলো ভালো ভালো ‘ন' মাথার মধ্যে হাহাকার করে বেড়াচ্ছে, মিলিয়ে দিতে পারছি নে — নিভৃত নিকুঞ্জনিলয়, নিপুণনূপুরনিক্কণ, নিবিড়নীরদনির্‌মুক্ত— অক্ষয়দাদা থাকলে ভাবতে হত না। মাস্টারমশায়কে দেখবামাত্র ছেলেগুলো যেমন বেঞ্চে নিজ নিজ স্থানে সার বেঁধে বসে তেমনি অক্ষয়দাদার সাড়া পাবামাত্র কথাগুলো দৌড়ে এসে জুড়ে দাঁড়ায়। — শ্রীশবাবু, বুড়ো মানুষকে বঞ্চনা করে রুমালখানা চুপি চুপি পকেটে পুরবেন না —

শ্রীশ। আবিষ্কারকর্তার অধিকার সকলের উপর —

রসিক। আমার ঐ রুমালখানিতে একটু প্রয়োজন আছে শ্রীশবাবু। আপনাকে তো বলেছি আমার নির্জন ঘরের একটিমাত্র জানলা দিয়ে একটুমাত্র চাঁদের আলো আসে, আমার একটি কবিতা মনে পড়ে —

বীথীষু বীথীষু বিলাসিনীনাং

মুখানি সংবীক্ষ্য শুচিস্মিতানি

জালেষু জালেষু করং প্রসার্য

লাবণ্যভিক্ষামটতীব চন্দ্রঃ।

কুঞ্জ - পথে পথে চাঁদ উঁকি দেয় আসি,

দেখে বিলাসিনীদের মুখভরা হাসি।

কর প্রসারণ করি ফিরে সে জাগিয়া

বাতায়নে বাতায়নে লাবণ্য মাগিয়া।

হতভাগা ভিক্ষুক আমার বাতায়নটায় যখন আসে তখন তাকে কী দিয়ে ভোলাই বলুন তো। কাব্যশাস্ত্রের রসালো জায়গা যা - কিছু মনে আসে সমস্ত আউড়ে যাই, কিন্তু কথায় চিঁড়ে ভেজে না। সেই দুর্ভিক্ষের সময় ঐ রুমালখানি বড়ো কাজে লাগবে। ওতে অনেকটা লাবণ্যের সংস্রব আছে।

শ্রীশ। সে লাবণ্য দৈবাৎ কখনো দেখেছেন রসিকবাবু?

রসিক। দেখেছি বৈকি, নইলে কি ঐ রুমালখানার জন্যে এত লড়াই করি। আর ঐ - যে ‘ন' অক্ষরের কথাগুলো আমার মাথার মধ্যে এখনো এক ঝাঁক ভ্রমরের মতো গুঞ্জন করে বেড়াচ্ছে তাদের সামনে কি একটি কমলবনবিহারিণী মানসীমূর্তি নেই।

শ্রীশ। রসিকবাবু, আপনার ঐ মগজটি একটি মৌচাক - বিশেষ, ওর ফুকোরে ফুকোরে কবিত্বের মধু। আমাকে সুদ্ধ মাতাল করে দেবেন দেখছি।

দীর্ঘনিশ্বাসপতন

 

পুরুষবেশী শৈলবালার প্রবেশ

 

শৈলবালা। আমার আসতে অনেক দেরি হয়ে গেল, মাপ করবেন শ্রীশবাবু।

শ্রীশ। আমি এই সন্ধেবেলায় উৎ পাত করতে এলুম, আমাকেও মাপ করবেন অবলাকান্তবাবু।