চিরকুমার-সভা
তেমন হবে না। তাদের সেই চিরকালের ঢেঁকি - ঘানির কিছু পরিবর্তন করতে পারলে তবে তাদের সমস্ত মন সজাগ হয়ে উঠবে, পৃথিবী যে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে নেই এ তারা বুঝতে পারবে —

শ্রীশ। চন্দ্রবাবু, বসবেন না কি।

চন্দ্রবাবু। থাক্‌ - না। একবার ভেবে দেখো, আমরা যে এতকাল ধরে শিক্ষা পেয়ে আসছি, উচিত ছিল আমাদের ঢেঁকি কুলো থেকে তার পরিচয় আরম্ভ হওয়া। বড়ো বড়ো কল - কারখানা তো দূরের কথা, ঘরের মধ্যেই আমাদের সজাগ দৃষ্টি পড়ল না। আমাদের হাতের কাছে যা আছে আমরা না তার দিকে ভালো করে চেয়ে দেখলুম, না তার সম্বন্ধে চিন্তা করলুম। যা ছিল তা তেমনিই রয়ে গেছে। মানুষ অগ্রসর হচ্ছে অথচ তার জিনিসপত্র পিছিয়ে থাকছে, এ কখনো হতেই পারে না। আমরা পড়েই আছি — ইংরেজ আমাদের কাঁধে করে বহন করছে, তাকে এগোনো বলে না। ছোটোখাটো সামান্য গ্রাম্য জীবনযাত্রা পল্লীগ্রামের পঙ্কিল পথের মধ্যে বদ্ধ হয়ে অচল হয়ে আছে, আমাদের সন্ন্যাসীসম্প্রদায়কে সেই গোরুর গাড়ির চাকা ঠেলতে হবে — কলের গাড়ির চালক হবার দুরাশা এখন থাক্‌। — ক'টা বাজল শ্রীশবাবু।

শ্রীশ। সাড়ে আটটা বেজে গেছে।

চন্দ্রবাবু। তা হলে আমি যাই। কিন্তু এই কথা রইল, আমাদের এখন অন্য - সমস্ত আলোচনা ছেড়ে নিয়মিত শিক্ষাকার্যে প্রবৃত্ত হতে হবে এবং —

পূর্ণ। আপনি যদি একটু বসেন চন্দ্রবাবু, তা হলে আমার দুই - একটা কথা বলবার আছে—

চন্দ্রবাবু। না, আজ আর সময় নেই —

পূর্ণ। বেশি কিছু নয়, আমি বলছিলুম আমাদের সভা —

চন্দ্রবাবু। সে কথা কাল হবে পূর্ণবাবু।

পূর্ণ। কিন্তু কালই তো সভা বসছে —

চন্দ্রবাবু। আচ্ছা, তা হলে পরশু। আমার সময় নেই —

পূর্ণ। দেখুন, অক্ষয়বাবু যে —

চন্দ্রবাবু। পূর্ণবাবু, আমাকে মাপ করতে হবে, আজ দেরি হয়ে গেছে। — কিন্তু দেখো, আমার একটা কথা মনে হচ্ছিল যে, চিরকুমার - সভা যদি ক্রমে বিস্তীর্ণ হয়ে পড়ে তা হলে আমাদের সকল সভ্যই কিছু সন্ন্যাসী হয়ে বেরিয়ে যেতে পারবেন না, অতএব ওর মধ্যে দুটি বিভাগ রাখা দরকার হবে —

পূর্ণ। স্থাবর এবং জঙ্গম।

চন্দ্রবাবু। তা সে যে নামই দাও। তা ছাড়া অক্ষয়বাবু সেদিন একটি কথা যা বললেন সেও আমার মন্দ লাগল না। তিনি বলেন, চিরকুমার - সভার সংস্রবে আর - একটি সভা রাখা উচিত যাতে বিবাহিত এবং বিবাহ - সংকল্পিত লোকদের নেওয়া যেতে পারে। গৃহী লোকদেরও তো দেশের প্রতি কর্তব্য আছে। সকলেরই সাধ্যমত কোনো - না - কোনো হিতকর কাজে নিযুক্ত থাকতে হবে — এইটে হচ্ছে সাধারণ ব্রত। আমাদের একদল কুমারব্রত ধারণ করে দেশে দেশে বিচরণ করবেন, একদল কুমারব্রত ধারণ করে এক জায়গায় স্থায়ী হয়ে বসে কাজ করবেন, আর - এক দল গৃহী নিজ নিজ রুচি ও সাধ্য - অনুসারে একটা কোনো প্রয়োজনীয় কাজ অবলম্বন করে দেশের প্রতি কর্তব্য পালন করবেন। যাঁরা পর্যটক - সম্প্রদায়ভুক্ত হবেন তাঁদের ম্যাপ - প্রস্তুত, জরিপ, ভূতত্ত্ববিদ্যা, উদ্ভিদ্‌বিদ্যা, প্রাণীতত্ত্ব প্রভৃতি শিখতে হবে ; তাঁরা যে দেশে যাবেন সেখানকার সমস্ত তথ্য তন্ন তন্ন করে সংগ্রহ করবেন — তা হলেই ভারতবর্ষীয়ের দ্বারা ভারতবর্ষের যথার্থ বিবরণ লিপিবদ্ধ হবার ভিত্তি স্থাপিত হতে পারবে, হন্টার