চিরকুমার-সভা

চন্দ্রবাবু পান - তামাকের জন্য সনাতন চাকরকে ডাকিবার উপক্রম করিলেন

পূর্ণ ‘আমি ডাকিয়া দিতেছি' বলিয়া উঠিল —

পাশের ঘরে চাবি এবং চুড়ি এবং সহসা পলায়নের শব্দ একসঙ্গে শোনা গেল

অক্ষয়। যস্মিন্‌ দেশে যদাচারঃ। যতক্ষণ আমি এখানে আছি ততক্ষণ আমি আপনাদের চিরকুমার, কোনো প্রভেদ নেই। এখন আমার প্রস্তাবটা শুনুন।

চন্দ্রবাবু টেবিলের উপর কার্যবিবরণের খাতাটির প্রতি অত্যন্ত ঝুঁকিয়া পড়িয়া মন দিয়া শুনিতে লাগিলেন

 

অক্ষয়। আমার কোনো মফস্বলের ধনী বন্ধু তাঁর একটি সন্তানকে আপনাদের কুমার - সভার সভ্য করতে ইচ্ছা করেছেন।

চন্দ্রবাবু। ( বিস্মিত হইয়া ) বাপ ছেলেটির বিবাহ দিতে চান না!

অক্ষয়। সে আপনারা নিশ্চিন্ত থাকুন — বিবাহ সে কোনোক্রমেই করবে না, আমি তার জামিন রইলুম। তার দূর সম্পর্কের এক দাদা - সুদ্ধ সভ্য হবেন। তাঁর সম্বন্ধেও আপনারা নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন। কারণ যদিচ তিনি আপনাদের মতো সুকুমার নন, কিন্তু আপনাদের সকলের চেয়ে বেশি কুমার, তাঁর বয়স ষাট পেরিয়ে গেছে — সুতরাং তাঁর সন্দেহের বয়সটা আর নেই, সৌভাগ্যক্রমে সেটা আপনাদের সকলেরই আছে।

চন্দ্রবাবু। সভ্যপদপ্রার্থীদের নাম ধাম বিবরণ —

অক্ষয়। অবশ্যই তাঁদের নাম ধাম বিবরণ একটা আছেই, সভাকে তার থেকে বঞ্চিত করতে পারা যাবে না — সভ্য যখন পাবেন তখন নাম ধাম বিবরণ - সুদ্ধই পাবেন। কিন্তু আপনাদের এই এক তলার স্যাঁৎ সেঁতে ঘরটি স্বাস্থ্যের পক্ষে অনুকূল নয় ; আপনাদের এই চিরকুমার - ক'টির চিরত্ব যাতে হ্রাস না হয় সে দিকে একটু দৃষ্টি রাখবেন।

চন্দ্র। ( কিঞ্চিৎ লজ্জিত হইয়া খাতাটি নাকের কাছে তুলিয়া লইয়া ) অক্ষয়বাবু, আপনি জানেন তো আমাদের আয় —

অক্ষয়। আয়ের কথাটা আর প্রকাশ করবেন না, আমি জানি ও আলোচনাটা চিত্তপ্রফুল্লকর নয়। ভালো ঘরের বন্দোবস্ত করে রাখা হয়েছে, সেজন্যে আপনাদের ধনাধ্যক্ষকে স্মরণ করতে হবে না। চলুন - না, আজই সমস্ত দেখিয়ে শুনিয়ে আনি।

বিমর্ষ বিপিন - শ্রীশের মুখ উজ্জ্বল হইয়া উঠিল। সভাপতিও প্রফুল্ল হইয়া উঠিয়া চুলের মধ্য দিয়া বার বার আঙুল

বুলাইতে বুলাইতে চুলগুলাকে অত্যন্ত অপরিষ্কার করিয়া তুলিলেন। কেবল পূর্ণ অত্যন্ত দমিয়া গেল

 

পূর্ণ। সভার স্থান - পরিবর্তনটা কিছু নয়।

অক্ষয়। কেন, এ বাড়ি থেকে ও বাড়ি করলেই কি আপনাদের চিরকৌমার্যের প্রদীপ হাওয়ায় নিবে যাবে।

পূর্ণ। এ ঘরটি তো আমাদের মন্দ বোধ হয় না।

অক্ষয়। মন্দ নয়। কিন্তু এর চেয়ে ভালো ঘর শহরে দুষ্প্রাপ্য হবে না।

পূর্ণ। আমার তো মনে হয় বিলাসিতার দিকে মন না দিয়ে খানিকটা কষ্টসহিষ্ণুতা অভ্যাস করা ভালো।

শ্রীশ। সেটা সভার অধিবেশনে না করে সভার বাইরে করা যাবে।

বিপিন। একটা কাজে প্রবৃত্ত হলেই এত ক্লেশ সহ্য করবার অবসর পাওয়া যায় যে, অকারণে বলক্ষয় করা মূঢ়তা।

অক্ষয়। বন্ধুগণ, আমার পরামর্শ শোনো, সভাঘরের অন্ধকার দিয়ে চিরকৌমার্যব্রতের অন্ধকার আর বাড়িয়ো না। আলোক এবং বাতাস স্ত্রীজাতীয় নয়, অতএব সভার মধ্যে ও দুটোকে প্রবেশ করতে বাধা দিয়ো না। আরো বিবেচনা করে দেখো,