চিরকুমার-সভা
গণ্ডার লুঠি তো ভাণ্ডার' যদি পণ ক'রে বস তবে গণ্ডারও বাঁচবে, ভাণ্ডারও বাঁচবে, তুমিও যেমন আরামে আছ তেমনি আরামে থাকবে। আমি প্রস্তাব করি, আমরা প্রত্যেকে দুটি করে বিদেশী ছাত্র পালন করব, তাদের পড়াশুনো এবং শরীরমনের সমস্ত চর্চার ভার আমাদের উপর থাকবে।

শ্রীশ। এই তোমার কাজ! এর জন্যই আমরা সন্ন্যাসধর্ম গ্রহণ করেছি? শেষকালে ছেলে মানুষ করতে হবে! তা হলে নিজের ছেলে কী অপরাধ করেছে।

বিপিন। ( বিরক্ত হইয়া ) তা যদি বল তা হলে সন্ন্যাসীর তো কর্মই নেই ; কর্মের মধ্যে ভিক্ষে আর ভ্রমণ আর ভণ্ডামি।

শ্রীশ। ( রাগিয়া ) আমি দেখছি আমাদের মধ্যে কেউ কেউ আছেন এ সভার মহৎ উদ্দেশ্যের প্রতি যাঁদের শ্রদ্ধামাত্র নেই, তাঁরা যত শীঘ্র এ সভা পরিত্যাগ করে সন্তানপালনে প্রবৃত্ত হন ততই আমাদের মঙ্গল।

বিপিন। ( আরক্তবর্ণ হইয়া ) নিজের সম্বন্ধে কিছু বলতে চাই নে, কিন্তু এ সভায় এমন কেউ কেউ আছেন যাঁরা সন্ন্যাসগ্রহণের কঠোরতা এবং সন্তানপালনের ত্যাগস্বীকার দুয়েরই অযোগ্য, তাঁদের —

চন্দ্রবাবু। ( চোখের কাছ হইতে কার্যবিবরণের খাতা নামাইয়া ) উত্থাপিত প্রস্তাব সম্বন্ধে পূর্ণবাবুর অভিপ্রায় জানতে পারলে আমার মন্তব্য প্রকাশ করবার অবসর পাই।

পূর্ণ। অদ্য বিশেষরূপে সভার ঐক্য - বিধানের জন্য একটা কাজ অবলম্বন করবার প্রস্তাব করা হয়েছে। কিন্তু কাজের প্রস্তাবে ঐক্যের লক্ষণ কিরকম পরিস্ফুট হয়ে উঠেছে সে আর কাউকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখাবার দরকার নেই। ইতিমধ্যে আমি যদি আবার একটা তৃতীয় মত প্রকাশ করে বসি তা হলে বিরোধানলে তৃতীয় আহুতি দান করা হবে — অতএব আমার প্রস্তাব এই যে, সভাপতিমশায় আমাদের কাজ নির্দেশ করে দেবেন এবং আমরা তাই শিরোধার্য করে নিয়ে বিনা বিচারে পালন করে যাব, কার্যসাধন এবং ঐক্যসাধনের এই একমাত্র উপায় আছে।

পাশের ঘরে এক ব্যক্তি আবার একবার নড়িয়া - চড়িয়া বসিল

এবং তাহার চাবি ঝন্‌ করিয়া উঠিল

 

চন্দ্রবাবু। আমাদের প্রথম কর্তব্য ভারতবর্ষের দারিদ্র্যমোচন, এবং তার আশু উপায় বাণিজ্য। আমরা কয়জনে বড়ো বাণিজ্য চালাতে পারি নে, কিন্তু তার সূত্রপাত করতে পারি। মনে করো আমরা সকলেই যদি দিয়াশলাই সম্বন্ধে পরীক্ষা আরম্ভ করি। এমন যদি একটা কাঠি বের করতে পারি যা সহজে জ্বলে, শীঘ্র নেবে না এবং দেশের সর্বত্র প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়,তা হলে দেশে সস্তা দেশালাই - নির্মাণের কোনো বাধা থাকে না। আমি বলছি শুধু ও জিনিসটা প্রস্তুত করার প্রণালী জানলেই তো হবে না। আমাদের দেশে যত রকম কাঠ মেলে তার মধ্যে কোন্‌ কাঠটা সব চেয়ে দাহ্য তার সন্ধান করা চাই।

বিপিন। দাহনতত্ত্ব সম্বন্ধে পূর্ণবাবুর কিছু অভিজ্ঞতা আছে বলে মনে হয়।

চন্দ্রবাবু। তাই নাকি। কী পূর্ণ, তুমি কি দাহ্য পদার্থের পরীক্ষা করেছ নাকি।

পূর্ণ। আমার মনে হয় খ্যাংরা কাঠি জিনিসটা সস্তাও বটে অথচ —

বিপিন। হাঁ, অথচ ওটা সহজেই জ্বালা ধরিয়ে দেয়, কিন্তু কুমার - সভায় তার পরীক্ষা সহজ নয়।

চন্দ্রবাবু। কী বলছেন বিপিনবাবু। কথাটা শুনতে পেলুম না।

বিপিন। আমি বলছিলুম, আমাদের দেশে দাহ্য পদার্থ যথেষ্ট আছে, যাতে দাহন করে এমন জিনিসেরও অভাব নেই ; কিন্তু পরীক্ষাটা খুব বিবেচনাপূর্বক করা চাই।