গোড়ায় গলদ

বিনোদবিহারী। তুই আর জ্বালাস নে নলিন। বুঝেছ চন্দরদা, যা কিছু মনে করবার তা করেছি—তাকে আমি চোখ বুজে পরী অপ্সরী রম্ভা তিলোত্তমা বলে কল্পনা করি কিন্তু তাতে ফল পাই নে। তবে সত্যি কথা বলি চন্দর, আসলে হয়েছে কী,আজকাল টাকার বড়ো টানাটানি—বই থেকে কিছু পাই নে, দেশে যা বিষয় আছে মামাতো ভাইরা লুঠ করে খেলে—নিজে পাড়াগাঁয়ে পড়ে থেকে বিষয় দেখা,সে মরে গেলেও পারব না—ওকালতি ব্যবসা সবে ধরেছি, ঘর থেকে কেবল গাড়ি-ভাড়াই দিচ্ছি। একলা যখন থাকতুম, আমার কোণের ঘরের ভাঙা চৌকিটিতে এসে বসতুম, আপনাকে রাজা মনে হত। এখন নড়তে-চড়তে কেবল মনে হয় আমার এই ভাঙা ঘর ছেঁড়া বিছানাটুকুও বেদখল হয়ে গেছে—আমাকে আর-কোথাও ভালো করে ধরে না। নিমাই, তুমি শুনে রাগ করছ, কিন্তু একটু বুঝে দেখো, একটা জুতোর মধ্যে দুটো পা ঢোকে না, তা দুই পায়ে যতই প্রণয় থাক্‌।

নলিনাক্ষ। বিনু যা বলছে ওর সমস্ত কথাই আমি মানি।

নিমাই। তা হলে তোমার ভালোবাসার অভাব নেই, কেবল টাকার অভাব।

বিনোদবিহারী। কথাটা যে প্রায় একই দাঁড়ায়—

নিমাই। কী বল! কথাটা একই! ভালোবাসাকে তুমি একেবারে উড়িয়ে দিতে চাও—

বিনোদবিহারী। না ভাই, আমি ভালোবাসাটাকে স্নায়ুর ব্যামো কিংবা মিথ্যে বলছি নে; আমি বলছি ও জিনিসটা কিছু শৌখিন জাতের। ওর বিস্তর আসবাবের দরকার। টানাটানির বাজারে ওকে নিয়ে বড়ো বিব্রত হয়ে পড়তে হয়। আমি বেশ বুঝতে পারি, চতুর্দিকটি বেশ মনের মতো হত, ট্রামের ঘড়ঘড় না থাকত, দাসীমাগী ঝগড়া না করত, গয়লা ঠিক নিয়মিত দুধ জোগাত এবং দাম না চাইত, মাসান্তে বাড়িওয়ালা একবার করে অপমান করে না যেত, জজসাহেব বিচারাসনে বসে আমার ইংরিজি ভুল সংশোধন করে না দিত, তা হলে আমিও ক্রমে ক্রমে ভালোবাসতে পারতুম—কিন্তু এখন সংগীত, চাঁদের আলো, প্রেমালাপ, এ কিছুই রুচছে না—আমার পটলডাঙার সেই বাসার মধ্যে এ-সমস্ত শৌখিন জিনিস পুষতে পারছি নে।

চন্দ্রকান্ত। ভালোবাসা যে এতবড়ো ফুলবাবু তা জানতুম না—কী করেই বা জানব, ওঁর সঙ্গে আমার কখনোই পরিচয় নেই।

নিমাই। ছি ছি বিনোদ, তোমার এতদিনকার কবিত্ব শেষকালে পয়সার থলির মধ্যে গুঁজলে হে!

বিনোদবিহারী। নিমাই, তুমি এমন কথাটা বললে! আমি দুর্গন্ধ পয়সার কাঙাল! ছোঃ! অভাবকে কি আমি অভাব বলে ডরাই—তা নয়, কিন্তু তার চেহারাটা অতি বিশ্রী, জীর্ণশীর্ণ, মলিন, কুৎসিত, কদাকার, হাড়-বের-করা; নিতান্ত গায়ের কাছে তাকে সর্বদা সহ্য হয় না। তার ময়লা হাতে সে পৃথিবীর যা-কিছু ছোঁয় তাই দাগি হয়ে যায়, তা চাঁদের আলোই বল, আর প্রেয়সীর হাসিই বল। এতদিন আমার টাকা ছিল না, অভাবও ছিল না —বিয়ের পর থেকে দারিদ্র্য বলে একটা কদর্য মড়াখেকো শ্মশানের কুকুর জিব বের করে সর্বদা আমার চোখের সামনে হ্যাঁহ্যাঁ করে বেড়াচ্ছে—তাকে আমি দু-চক্ষে দেখতে পারি নে। আসল কথা, আমার চারি দিকে আমি একটি সৌন্দর্যের সামঞ্জস্য দেখতে চাই—জীবনটি বেশ একটি অখণ্ড রাগিণীর মতো হবে, তবে আমার মধ্যে যা-কিছু পদার্থ আছে তা ভালো করে প্রকাশ পাবে। কিন্তু আমার এই নতুন স্ত্রীর সঙ্গে আমার পুরোনো অবস্থার ঠিক সুর মেলাতে পারছি নে, আমার কোনো জিনিস তাঁকে কেমন খাপ খাচ্ছে না, আর তাই ক্রমাগত আমাকে ছুঁচের মতো বিঁধছে। থাকত যদি আরব্য-উপন্যাসের একটি পোষা দৈত্য, স্ত্রীর ঘরে পদার্পণ করলেন অমনি একটি কিংকরী সোনার থালে হ্যামিল্টনের দোকানের সমস্ত ভালো ভালো গয়না এনে তাঁর পায়ের কাছে রেখে গেল, দু-জন দাসী বসবার ঘরে মছলন্দ বিছিয়ে চামর হাতে করে দুই দিকে দাঁড়াল, চারি দিক থেকে সংগীত উঠছে, বাগান থেকে ফুলের গন্ধ আসছে—যেদিকে চোখ পড়ছে তক তক ঝক ঝক করছে —সে হলে একরকম হত—আর এই এক জীর্ণ ঘরে ছেঁড়া মাদুরে উঠতে-বসতে লজ্জিত হয়ে আছি! যা বলিস ভাই, স্ত্রীর কাছে মান রাখতে সকলেরই সাধ যায়, এমন-কি, সেইজন্যে মনু বলে গেছেন স্ত্রীর কাছে মিথ্যা বলতে পাপ নেই। তা ভাই, মিথ্যা কথা দিয়ে যদি আমার