গোড়ায় গলদ
পটলডাঙার বাসাটা ঢেকে ফেলতে পারতুম, আমার বর্তমান অবস্থা আগাগোড়া গিলটি করে দিতে পারতুম, তা হলে মিথ্যে আমার মুখে বাধত না —কিন্তু এতখানি ছেঁড়া বেরিয়ে পড়ছে যে কেবল কথা দিয়ে আর রিফু চলে না। এখন এ অবস্থায় সে কি আমাকে মনে মনে শ্রদ্ধা করতে পারে। আমার মধ্যে যেটুকু পদার্থ আছে সে কি আমি তার কাছে প্রকাশ করতে পেরেছি। আমার সঙ্গে প্রথম পরিচয়েই সে আমাকে কী হীনতার মধ্যে দেখছে বলো দেখি। তুমি কি বল এ অবস্থায় মানুষের বসে বসে প্রেমালাপ করতে শখ যায়। এই তো ভাই, আমার যে রকম স্বভাব তা খুলে বললুম, খুব যে উঁচুদরের বীরত্বময় মহত্ত্বপূর্ণ তা নয়—কিন্তু উঁচু নিচু মাঝারি এই তিন রকমেরই মানুষ আছে, ওর মধ্যে আমাকে যে দলেই ফেল আমার আপত্তি নেই—কিন্তু ভুল বুঝো না।

চন্দ্রকান্ত। তোমার সঙ্গে বক্তৃতায় কে পারবে বলো। যা হোক, এখন কর্তব্য কী বলো দেখি।

বিনোদবিহারী। আমি তাঁকে তাঁর বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছি।

চন্দ্রকান্ত। তুমি নিজে চেষ্টা করে? না তিনি রাগ করে গেছেন?

বিনোদবিহারী। না, আমি তাঁকে একরকম বুঝিয়ে দিলুম—

চন্দ্রকান্ত। যে, এখানে তিনি টিঁকতে পারবেন না! তুমি সব পার। যদি বন্ধুত্ব রাখতে চাও তো ও-আলোচনায় আর কাজ নেই, তোমার যা কর্তব্য বোধ হয় তুমি কোরো। নিমাই ভাই, তোমার সে কথাটা মনে রইল—আগে একবার নিজের শ্বশুরবাড়িটা ঘুরে আসি, তার পরে বেশ উৎসাহের সঙ্গে কাজটায় লাগতে পারব। বিনু, আজ আমার মনটা কিছু অস্থির আছে, আজ আর থাকতে পারছি নে—কাল তোমার বাসায় একবার যাওয়া যাবে।

[ প্রস্থান

নলিনাক্ষ। চলো ভাই বিনু, আমরা দুজনে মিলে গোলদিঘির ধারে বেড়াতে যাই গে।

বিনোদবিহারী। আমার এখন গোলদিঘি বেড়াবার শখ নেই নলিন। সেখানে যখন যাব একেবারে দড়ি-কলসি হাতে করে নিয়ে যাব।

নলিনাক্ষ। কেন ভাই, অনর্থক তুমি ওরকম মন খারাপ করে রয়েছ? একে তো এই পোড়া সংসারে যথেষ্ট অসুখ আছে তার পরে আবার—

বিনোদবিহারী। বন্ধু লাগলে আরো অসহ্য হয়ে ওঠে।

নলিনাক্ষ। কী করলে তোমার দগ্ধ হৃদয়ে আমি একটুখানি সান্ত্বনা দিতে পারি ভাই।

বিনোদবিহারী। নলিন, তোর দুটি পায়ে পড়ি আমাকে সান্ত্বনা দেবার জন্যে এত অবিশ্রাম চেষ্টা করিস নে, মাঝে মাঝে একটু একটু হাঁপ ছাড়তে দিস।

নলিনাক্ষ। তুমি এখন কোথায় যাচ্ছ।

বিনোদবিহারী। বাড়ি যাচ্ছি।

নলিনাক্ষ। তবে আমিও তোমার সঙ্গে যাই। এখন তুমি সেখানে একলা, মনে করছি কিছুদিন তোমার সঙ্গে একত্র থেকে—

বিনোদবিহারী। না না, আমি শীঘ্রই আমার স্ত্রীকে ঘরে আনছি—নলিন, আজ ভাই তুমি চন্দরকে নিয়ে গোলদিঘিতে বেড়াতে যাও—আমাকে একটু ছুটি দিতেই হচ্ছে।

নলিনাক্ষ। (সনিশ্বাসে) তবে বিদায় ভাই! কিন্তু এই শেষ কথা বলে যাচ্ছি, যাঁদের তুমি তোমার প্রাণের বন্ধু বলে জান, তাঁরা তোমাকে হয়তো এক কথায় ত্যাগ করতে পারেন কিন্তু নলিনাক্ষ তোমাকে কখনোই ছাড়বে না।

বিনোদবিহারী। সে আমি খুবই জানি নলিন।

নলিনাক্ষ। আর এটা নিশ্চয় মনে রেখো, তুমি যা কর আমি তোমার পক্ষে আছি।

[ প্রস্থান