গোড়ায় গলদ

শিবচরণ। (সরোষে) তুই তো বলছিস এক কথা। আমিই কি এক কথার বেশি বলছি। মাঝের থেকে কথা যে আপনিই দুটো হয়ে যাচ্ছে। আমি এখন নিবারণকে বলি কী। তা সে যা হোক, তুই তা হলে নিবারণের মেয়ে ইন্দুমতীকে কিছুতেই বিয়ে করবি নে? যা বলবি এক কথা বল্‌।

নিমাই। কিছুতেই না বাবা।

শিবচরণ। একমাত্র বাগবাজারের কাদম্বিনীকেই বিয়ে করবি? ঠিক করে বলিস।

নিমাই। সেই রকমই স্থির করেছি—

শিবচরণ। বড়ো উত্তম কাজ করেছ —এখন আমি নিবারণকে কী বলব।

নিমাই। বলবেন, আপনার অবাধ্য ছেলে তাঁর কন্যা ইন্দুমতীর যোগ্য নয়।

শিবচরণ। কোথাকার নির্লজ্জ! আমাকে আর তোর শেখাতে হবে না। কী বলতে হবে তা আমি বিলক্ষণ জানি। তবে ওর আর কিছুতেই নড়চড় হবে না?

নিমাই। না বাবা, সেজন্যে আপনি ভাববেন না।

শিবচরণ। আরে ম’ল! আমি সেই জন্যেই ভেবে মরছি আর-কি! আমি ভাবছি, নিবারণকে বলি কী!


চতুর্থ অঙ্ক
প্রথম দৃশ্য
সুসজ্জিত গৃহ
বিনোদবিহারী
বিনোদবিহারী। এরা বেছে বেছে এত দেশ থাকতে আমাকে উকিল পাকড়ালে কী করে আমি তাই ভাবছি। আমার অদৃষ্ট ভালো বলতে হবে। এখন টিকতে পারলে হয়। যখন মেয়ে প্রভু তখন একটু একটু আশা হয়—একবার কোনো সুযোগে মনটি জোগাড় করতে পারলে স্থায়িত্ব সম্বন্ধে আর কোনো ভাবনা নেই। তা বলি, স্ত্রীলোকের থাকবার স্থান এই বটে। ওরা যে রানীর জাত, দারিদ্র্য ওদের আদবে শোভা পায় না। পুরুষমানুষ জন্মগরিব—সাজসজ্জা ঐশ্বর্য অলংকার আমাদের তেমন মানায় না। সেইজন্যই তো লক্ষ্মী যেমন সৌন্দর্যের দেবতা তেমনি ধনের দেবতা! শিবটা হল ভিক্ষুক আর দুর্গা হলেন অন্নপূর্ণা। মেয়েমানুষ একেবারে ভরা ভাণ্ডারের মাঝখানে এসে দাঁড়াবে, চারি দিক ঝলসে দেবে—কোথাও যে কিছু অভাব আছে তা কারো চোখে পড়বে না,মনে থাকবে না। আর আমরা গোলাম ওঁদের জন্য দিনরাত্রি মজুরি করে মরব। বাস্তবিক, ভেবে দেখতে গেলে পুরুষরা যে এত বেশি খেটে মরে সে কেবল মেয়েরা খাটবার জন্যে হয় নি বলে—পাছে ওঁদেরও খাটতে হয়, সেইজন্যে পুরুষকে পুরুষ আর মেয়ে দুয়ের জন্যেই একলা খেটে দিতে হয়—এইজন্যেই পুরুষের চেহারা এবং ভাবখানা এমন চোয়াড়ের মতো কেবল খেটে খাবার উপযুক্ত—খাটুনির মতো এমন আর-কিছু তাকে শোভা পায় না। রানী বসন্তকুমারীকে বোধ করি এই অতুল ঐশ্বর্যেরই উপযুক্ত দেখতে হবে। আমি বেশ দেখতে পাচ্ছি তাঁর এমন একটি মহিমা আছে যে, তাঁর পায়ের নীচে পৃথিবী নিজের ধুলোমাটির জন্যে ভারি অপ্রতিভ হয়ে পড়ে আছে। কী করবে, বেচারার নড়ে বসবার জায়গা নেই।
ঘোমটা পরিয়া কমলমুখীর প্রবেশ