প্রকল্প সম্বন্ধেপ্রকল্প রূপায়ণেরবীন্দ্র-রচনাবলীজ্ঞাতব্য বিষয়পাঠকের চোখেআমাদের লিখুনডাউনলোডঅন্যান্য রচনা-সম্ভার |
চন্দ্রকান্ত। সেজের বাতি নিবিয়ে দেবার ঠোঙাগুলোরও ওইরকম চেহারা। এই পঁচিশটা বৎসর যা-কিছু শিক্ষাদীক্ষা হয়েছে, যা-কিছু আশা-আকাঙ্ক্ষা জন্মেছিল—ভারতের ঐক্য, বাণিজ্যের উন্নতি, সমাজের সংস্কার, সাহেবের ছেলে পিটোনো প্রভৃতি যে-সকল উঁচু নীচু ভাবের পলতে মগজের ঘি খেয়ে খুব উজ্জ্বল হয়ে জ্বলে উঠেছিল—সেগুলিকে ঐ টোপরটা চাপা দিয়ে এক দমে নিবিয়ে সম্পূর্ণ ঠাণ্ডা হয়ে বসতে হবে—
নলিনাক্ষ। আর আমাদেরও মনে থাকবে না—একেবারে ভুলে যাবে—দেখা করতে এলে বলবে সময় নেই—
চন্দ্রকান্ত। কিংবা মহারানীর হুকুম নেই। কিন্তু সেটা তোমার ভারি ভুল। বন্ধুত্ব তখন আরো প্রগাঢ় হয়ে উঠবে। ওর জীবনের মধ্যাহ্নসূর্যটি যখন ঠিক ব্রহ্মরন্ধ্রের উপর ঝাঁ ঝাঁ করতে থাকবেন তখন এই কালো কালো ছায়াগুলিকে নিতান্ত খারাপ লাগবে না। কিন্তু দেখ্ বিনোদ, কিছু মনে করিস নে—আরম্ভেতে একটুখানি দমিয়ে দেওয়া ভালো—তা হলে আসল ধাক্কা সামলাবার বেলায় নিতান্ত অসহ্য বোধ হবে না। তখন মনে হবে, চন্দর যতটা ভয় দেখাত আসলে ততটা কিছু নয়। সে বলেছিল আগুনে, ঝলসাবার কথা কিন্তু এ তো কেবলমাত্র উলটে-পালটে তাওয়ায় সেঁকা—তখন কী অনির্বচনীয় আরাম বোধ হবে!
শ্রীপতি। চন্দরদা, ও কী তুমি বকছ! আজ বিয়ের দিনে কি ও-সব কথা শোভা পায়! একে তো বাজনা নেই, আলো নেই, উলু নেই, শাঁখ নেই, তার পরে যদি আবার অন্তিমকালের বোলচাল দিতে আরম্ভ কর তা হলে তো আর বাঁচি নে!
ভূপতি। মিছে না! চন্দরদার ও-সমস্ত মুখের আস্ফালন বেশ জানি— এ দিকে রাত্তির দশটার পর যদি আর এক মিনিট ধরে রাখা যায়, তা হলে ব্রাহ্মণ বিরহের জ্বালায় একেবারে অস্থির হয়ে পড়ে—
চন্দ্রকান্ত। ভূপতির আর কোনো গুণ না থাক্ ও মানুষ চেনে তা স্বীকার করতে হয়। ঘড়িতে ঐ-যে ছুঁচোলো মিনিটের কাঁটা দেখছ উনি যে কেবল কানের কাছে টিক টিক করে সময় নির্দেশ করেন তা নয় অনেক সময় প্যাঁট প্যাঁট করে বেঁধেন—মন-মাতঙ্গকে অঙ্কুশের মতো গৃহাভিমুখে তাড়না করেন। রাত্তির দশটার পর আমি যদি বাইরে থাকি তা হলে প্রতি মিনিট আমাকে একটি করে খোঁচা মেরে মনে করিয়ে দেন ঘরে আমার অন্ন ঠাণ্ডা এবং গৃহিণী গরম হচ্ছেন।—বিনুদার ঘড়ির সঙ্গে আজকাল কোনো সম্পর্কই নেই— এবার থেকে ঘড়ির ঐ চন্দ্রবদনে নানা রকম ভাব দেখতে পাবেন—কখনো প্রসন্ন কখনো ভীষণ। (নিমাইয়ের প্রতি) আচ্ছা ভাই বৈজ্ঞানিক, তুমি আজ অমন চুপচাপ কেন। এমন করলে তো চলবে না।
শ্রীপতি। সত্যি, বিনু যে বিয়ে করতে যাচ্ছে তা মনে হচ্ছে না। আমরা কতকগুলো পুরুষমানুষে জটলা করেছি—কী করতে হবে কেউ কিছু জানি নে—মহা মুশকিল! চন্দরদা, তুমি তো বিয়ে করেছ, বলো-না কী করতে হবে—হাঁ করে সবাই মিলে বসে থাকলে কি বিয়ে-বিয়ে মনে হয়।
চন্দ্রকান্ত। আমার বিয়ে—সে যে পুরাতত্ত্বের কথা হল— আমার স্মরণশক্তি ততদূর পৌঁছয় না। কেবল বিবাহের যেটি সর্বপ্রধান আয়োজন, যেটিকে কিছুতে ভোলবার জো নেই, সেইটিই অন্তরে বাহিরে জেগে আছে, মন্তর-তন্তর পুরুত-ভাট সে সমস্ত ভুলে গেছি।
ভূপতি। বাসরঘরে শ্যালীর কানমলা?
চন্দ্রকান্ত। হায় পোড়াকপাল! শ্যালীই নেই তো শ্যালীর কানমলা—মাথা নেই তার মাথাব্যথা! শ্যালী থাকলে তবু তো বিবাহের সংকীর্ণতা অনেকটা দূর হয়ে যায়—ওরই মধ্যে একটুখানি নিশ্বেস ফেলবার, পাশ ফেরবার জায়গা পাওয়া যায়—শ্বশুরমশায় একেবারে কড়ায়-গন্ডায় ওজন করে দিয়েছেন, সিকিপয়সার ফাউ দেন নি।
বিনোদবিহারী। বাস্তবিক—বর মনোনীত করবার সময় যেমন জিজ্ঞাসা করে,কটি পাস আছে, কনে বাছবার সময় তেমনি খোঁজ নেওয়া উচিত কটি ভগ্নী আছে।
চন্দ্রকান্ত। চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে—ঠিক বিয়ের দিনটিতে বুঝি তোমার চৈতন্য হল? তা তোমারও একটি আছে শুনেছি তার