প্রকল্প সম্বন্ধেপ্রকল্প রূপায়ণেরবীন্দ্র-রচনাবলীজ্ঞাতব্য বিষয়পাঠকের চোখেআমাদের লিখুনডাউনলোডঅন্যান্য রচনা-সম্ভার |
আমাদের এই যে দেশকে মুসলমানেরা বাঙ্গালা বলিতেন তাহার নামটি বর্তমানে আমরা কিরূপ বানান করিয়া লিখিব শ্রীযুক্ত বীরেশ্বর সেন মহাশয় [১৩২২] চৈত্রের প্রবাসীতে তার আলোচনা করিয়াছেন।
আমি মনে করি এর জবাবদিহি আমার। কেননা, আমিই প্রথমে বাংলা এই বানান ব্যবহার করিয়াছিলাম।
আমার কোনো কোনো পদ্যরচনার যুক্ত অক্ষরকে যখন দুই মাত্রা হিসাবে গণনা করিতে আরম্ভ করিয়াছিলাম তখনই প্রথম বানান সম্বন্ধে আমাকে সতর্ক হইতে হইয়াছিল। ‘ঙ্গ’ অক্ষরটি যুক্ত অক্ষর—উহার পুরা আওয়াজটি আদায় করিতে হইলে এক মাত্রা ছড়াইয়া যায়। সেটা আমার ছন্দের পক্ষে যদি আবশ্যক হয় তো ভালোই, যদি না হয় তবে তাকে প্রশ্রয় দেওয়া চলে না।
এক-একটি অক্ষর প্রধানত এক-একটি আওয়াজের পরিচয়, শব্দতত্ত্বের নহে। সেটা বিশেষ করিয়া অনুভব করা যায় ছন্দরচনায়। শব্দতত্ত্ব অনুসারে লিখিব এক, আর ব্যবহার অনুসারে উচ্চারণ করিব আর, এটা ছন্দ পড়িবার পক্ষে বড়ো অসুবিধা। যেখানে যুক্ত অক্ষরেই ছন্দের আকাঙ্ক্ষা সেখানে যুক্ত অক্ষর লিখিলে পড়িবার সময় পাঠকের কোনো সংশয় থাকে না। যদি লেখা যায়—
বাঙ্গলা দেশে জন্মেছ বলে
বাঙ্গালী নহ তুমি;
সন্তান হইতে সাধনা করিলে
লভিবে জন্মভূমি—
তবে অমি পাঠকের নিকট ‘ঙ্গ’ যুক্ত-অক্ষরের পুরা আওয়াজ দাবি করিব। অর্থাৎ এখানে মাত্রাগণনায় বাঙ্গলা শব্দ হইতে চার মাত্রার হিসাব চাই। কিন্তু যখন লিখিব, ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’ তখন উক্ত বানানের দ্বারা কবির এই প্রার্থনা প্রকাশ পায় যে ‘বাংলা’ শব্দের উপর পাঠক যেন তিন মাত্রার অতিরিক্ত নিশ্বাস খরচ না করেন। ‘বাঙ্গলার মাটি’ যথারীতি পড়িলে এইখানে ছন্দ মাটি হয়।
ঝিঙা না ভাজিয়া ভাজিলে ঝিঙ্গা
ছন্দ তখনি ফুঁকিবে শিঙ্গা।
এই গেল ছন্দব্যবসায়ী কবির কৈফিয়ত।
কিন্তু শুধু কেবল কাব্যক্ষেত্রে ডিক্রি পাইয়াই আমি সন্তুষ্ট থাকিব না, আমার আরো কিছু বলিবার আছে। বীরেশ্বরবাবুর মতে মূল শব্দের সহিত তদ্ভব শব্দের বানানের সাদৃশ্য থাকা উচিত। যদি তাঁর কথা মানিতে হয় তবে বাংলার বানান-মহালে হুলস্থূল পড়িয়া যায়। এই আইন অনুসারে কিরূপ পরিবর্তন হয় তার গোটাকতক নমুনা দেখা যাক। ‘শাঁখ—শাঙ্খ্। আঁক—আঙ্ক্। চাঁদ—চাঁন্দ্। রাখ—রাক্ষ। আমি—আহ্মি।
হয়তো বীরেশ্বরবাবু বলিলেন, হাঁ এইরূপ হওয়াই উচিত। তাঁর পক্ষে ভালো নজিরও আছে। ইংরেজিতে বানানে-উচ্চারণে ভাসুর-ভাদ্রবৌ সম্পর্ক, পরস্পরের মাঝখানে প্রাচীন শব্দতত্ত্বের লম্বা ঘোমটা। ইংরেজিতে লিখি ট্রেআসূরে (treasure) পড়ি ট্রেজার; লিখি ক্নৌলেডগে (knowledge) পড়ি নলেজ্; লিখি রিঘ্টেওউস (righteous) পড়ি রাইটিয়স। অতএব যদি লিখি পক্ষী অথচ পড়ি পাখী, লিখি বিদ্যুলি পড়ি বিজুলি, লিখি শ্রবণিয়াছিলাম পড়ি শুনিয়াছিলাম, বিলাতিমতে তাহাতে দোষ হয় না।