পরিশিষ্ট
ব্যাপক রস মানবসমাজে আর নাই, শিশু হইতে বৃদ্ধ পর্যন্ত সর্বত্রই ইহার অধিকার। তবু তো রসনাতৃপ্তির আনন্দ সাহিত্যে কেবলমাত্র বিদূষককে আশ্রয় করিয়া নিজেকে হাস্যকর করিয়াছে। গীতিকাব্যের ছন্দে তাহার রসলীলা প্রকাশ পায় নাই, মহাকাব্যের মহাসভা হইতে সে তিরস্কৃত। অথচ গোপনে অনুসন্ধান করিলে জানা যাইবে যে, কবিজাতি স্বভাবতই ভোজনে অপটু বা মিষ্টা অরসিক—শত্রুপক্ষেও এমন অপবাদ দেয় না।

ইহার একটা কারণ আছে। ভোজনের তৃপ্তিটুকু উদরপূরণের প্রয়োজনে প্রায়ই নিঃশেষ হইয়া যায়। তাহা আর উদ্‌বৃত্ত থাকে না। যে রস উদ্‌বৃত্ত থাকে না সে আপনাকে প্রকাশ করিবার জন্য ব্যাকুল হয় না। যেটুকু বৃষ্টি মাটির মধ্যেই শুষিয়া যায় তাহা তো আর স্রোতের আকারে বহিয়া যাইতে পারে ন। এই কারণেই রসের সচ্ছলতায় সাহিত্য হয় না, রসের উচ্ছলতায় সাহিত্যের সৃষ্টি।

কতকগুলি রস আছে যাহা মানুষের প্রয়োজনকে অনেক দূর পর্যন্ত ছাপাইয়া উৎসারিত হইয়া উঠে। তাহার মুখ্যধারা আমাদের আবশ্যকে নিঃশেষ হয় এবং গৌণধারা নানাপ্রকার ইন্দ্রজাল সৃষ্টি করিতে চায়। বীরপুরুষ মুখ্যভাবে তরবারিকে আপনার অস্ত্র বলিয়া জানে; কিন্তু বীরত্বগৌরব সেইটুকুতেই তৃপ্ত থাকিতে পারে নাই, সে তরবারিতে কারুকার্য ফলাইয়াছে। কলু নিজের ঘানিকে কেবলমাত্র কাজের ঘানি করিয়াই সন্তুষ্ট; তাহার মধ্যে গৌণপ্রকাশ কিছুই নাই। ইহাতে প্রমাণ হয়, ঘানি কলুর মনে সেই ভাবের উদ্রেক করিতে পারে নাই যাহা আবশ্যক শেষ করিয়াও অনাবশ্যকে আপনার আনন্দ ব্যক্ত করে। এই রসের অতিরিক্ততাই সংগীতকে ছন্দকে নানাপ্রকার ললিতকলাকে আশ্রয় করিতে চায়। তাহাই ব্যবহারের-অতীত অহেতুক হইয়া অনির্বচনীয়রূপে আপনাকে প্রকাশ করিতে চায়। নায়ক-নায়িকার যে প্রেম কেবলমাত্র দর্শনস্পর্শনের মধ্যেই গাহিয়া উঠে—

‘জনম অবধি হম রূপ নেহারনু

নয়ন না তিরপিত ভেল,

লাখ লাখ যুগ হিয়ে হিয়ে রাখনু

তবু হিয় জুড়ন না গেল’

তার সে মুহূর্তকালের দেখাশুনা কেবল সেই মুহূর্তটুকুর মধ্যে নিজেকে ধারণ করিতে পারে না বলিয়াই লক্ষ লক্ষ যুগের আকাঙ্ক্ষা সংগীতের মধ্যে সৃষ্টি না করিয়া বাঁচে না।

অতএব যে রস মানবের সর্বপ্রকার প্রয়োজনমাত্রকে অতিক্রম করিয়া বাহিরের দিকে ধাবিত হয় তাহাই সাহিত্যরস। এইরূপ, প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদকেই আমরা ঐশ্বর্য বলিয়া থাকি। সাহিত্য মানবহৃদয়ের ঐশ্বর্য। ঐশ্বর্যেই সকল মানুষ সম্মিলিত হয়; যাহা অতিরিক্ত তাহাই সর্বসাধারণের।

ময়ূরশরীরের যে উদ্যমটা অতিরিক্ত তাহাই তাহার বিপুল পুচ্ছে অনাবশ্যক বর্ণচ্ছটায় বিচিত্র হইয়া উঠে; এই কলাপশোভা ময়ূরের একলার নহে, তাহা বিশ্বের। প্রভাতে আলোকে পাখির আনন্দ যখন তাহার আহারবিহারের প্রয়োজনকে ছাপাইয়া উঠিতে থাকে তখনই সেই গানের অপরিমিত ঐশ্বর্যে পাখি বিশ্বসাধারণের সহিত নিজের যোগস্থাপন করে। সাহিত্যেও তেমনি মানুষ আষাঢ়ের মেঘের মতো যে রসের ধারা এবং যে জ্ঞানের ভার নিজের প্রয়োজনের মধ্যে আর ধারণ করিয়া রাখিতে পারে না তাহাকেই বিশ্বমানবের মধ্যে বর্ষণ করিতে থাকে। এই উপায়েই সাহিত্যের দ্বারাই হৃদয়ের সঙ্গে হৃদয়, মনের সঙ্গে মন, মিলিত হইয়া মানুষ ক্রমাগত স্বকীয়, এমন-কি স্বজাতীয়, স্বাতন্ত্র্যের ঊর্ধ্বে বিপুল বিশ্বমানবে পরিণত হইবার অভিমুখে চলিয়াছে। এই কারণেই আমি মনে করি আমাদের ভাষায় ‘সাহিত্য’ শব্দটি সার্থক। ইহাতে আমরা নিজের অত্যাবশ্যক অতিক্রম করিয়া উদারভাবে মানুষের ও বিশ্বপ্রকৃতির সাহিত্য লাভ করি।

কোনো দেশে যখন অতিমাত্রায় প্রয়োজনের কাড়াকাড়ি পড়িয়া যায় তখন সেখানে সাহিত্য নির্জীব হইয়া পড়ে। কারণ,