পরিশিষ্ট
ফোঁটা আমরাই সকলের আগে আদায় করিয়া ছাড়িব। ইহাতে কেহ ঝগড়া করিতে আসিলে চলিবে না। আমাদের অন্য ভাইরা, যাঁহারা সুদীর্ঘকাল পশ্চিমমুখে আসন করিয়া পাষাণদেবতার বধির কানটার কাছে কাঁসর ঘন্টা বাজাইতে বাজাইতে ডান হাতটাকে একেবারে অবসন্ন করিয়া ফেলিয়াছেন, তাঁহারাই যে আমাদিগকে পিছনে ঠেলিয়া আজ প্রধান হইয়া দাঁড়াইবেন, এ আমরা সহ্য করিব কেন? স্বদেশের মিলনক্ষেত্রে একদিন যখন কাহারো কোনো সাড়াশব্দ ছিল না, যখন ইহাকে শ্মশান বলিয়া ভ্রম হইত, তখন সাহিত্যই কোদাল কাঁধে করিয়া ইহার পথ পরিষ্কার করিতে বাহির হইয়াছিল। সেই পথ বাংলার উত্তরে দক্ষিণে পূর্বে পশ্চিমে বিস্তৃত হইয়াছে। সেই পথকে ক্রমশই চওড়া করিয়া পৃথিবীর অন্যান্য বড়ো বড়ো পণ্যপ্রবাহী রাজপথগুলির সঙ্গে মিলাইয়া দিবার আয়োজন কে করিয়াছিল?

একবার ভাবিয়া দেখুন, বাঙালিকে আমরা যে বাঙালি বলিয়া অনুভব করিতেছি তাহা মানচিত্রে কোনো কৃত্রিম রেখার জন্য নহে। বাঙালির ঐক্যের মূলসূত্রটি কী? আমরা এক ভাষায় কথা কই। আমরা দেশের এক প্রান্তে যে বেদনা অনুভব করি ভাষার দ্বারা দেশের অপর সীমান্তে তাহা সঞ্চার করিয়া দিতে পারি; রাজা তাঁহার সমস্ত সৈন্যদল খাড়া করিয়া তাঁহার রাজদণ্ডের সমস্ত বিভীষিকা উদ্যত করিয়াও ইহা পারেন না। শতবৎসর পূর্বে আমাদের পূর্বপুরুষ যে গান গাহিয়া গিয়াছেন শতবৎসর পরেও সেই গান বাঙালির কন্ঠ হইতে উৎপাটিত করিতে পারে এত বড়ো তরবারি কোনো রাজাস্ত্রশালায় আজও শানিত হয় নাই। একি সামান্য শক্তি আমাদের প্রত্যেক বাঙালির হাতে আছে! এ শক্তি ভিক্ষালব্ধ নহে। ভূমিষ্ঠ হইবার পরক্ষণ হইতেই জননীর সুধাকন্ঠ হইতে স্নেহবিগলিত এই শক্তি আমরা আনন্দের সহিত সমস্ত মন প্রাণ দিয়া আকর্ষণ করিয়া লইয়াছি এবং এই চিরন্তন শক্তিযোগে সমস্ত দুরত্ব লঙ্ঘন করিয়া, অপরিচয়ের সমস্ত বাধা ভেদ করিয়া, আজ এই সভাতলে বর্তমান ও ভবিষ্যতের, উপস্থিত ও অনাগতের, সমস্ত বাঙালিকে আপন উদ্‌বেল হৃদয়ের সম্ভাষণ জানাইবার অধিকারী হইয়াছি।

বাঙালির সঙ্গে বাঙালিকে গাঁথিবার জন্য কত কাল ধরিয়া বঙ্গসাহিত্য হৃদয়তন্তু-নির্মিত নানা রঙের একটা বিপুল মিলনজাল রচনা করিয়া আসিয়াছে। আজ তাহা আমাদের এতে বেশি অঙ্গীভূত হইয়া গেছে যে, তাহা আমাদের শিরা পেশী প্রভৃতির মতো আমাদের চোখেই পড়িতে চায় না। এ দিকে রাজকীয় মন্ত্রণাসভায় দুই-একজন দেশীয় মন্ত্রী -নিয়োগ বা পৌরসভায় দুই-চরি জন দেশীয় প্রতিনিধি -নির্বাচনের শূন্যগর্ভ বিড়ম্বনাকেই আমরা পরম সৌভাগ্য বলিয়া গণ্য করি। ঔষধ যতই কটু হয় তাহাকে ততই হিতকর বলিয়া ভ্রম হয়; যে চেষ্টায় যত বেশি ব্যর্থ কষ্ট তাহার ফলটুকুকে ততই অধিক বলিয়া আমরা মনে করি। কারণ, ভাঙা পথে তৈলহীন গোরুর গাড়ির চাকার মতো পণ্ডশ্রমই সব চেয়ে বেশি শব্দ করিতে থাকে—তাহার অস্তিত্ব এক মুহূর্ত ভুলিয়া থাকা কঠিন।

কিন্তু কাজের সময় হঠাৎ দেখিতে পাই যাহা সত্য, যাহা কষ্টকল্পনা নহে, তাহার শক্তি অধিক, অথচ তাহা নিতান্ত সহজ। আমরা বিদেশী ভাষায় পরের দরবারে এত কাল যে ভিক্ষা কুড়াইলাম তাহাতে লাভের অপেক্ষা লাঞ্ছনার বোঝাই বেশি জমিল, আর দেশী ভাষায় স্বদেশীর হৃদয়-দরবারে যেমনি হাত পাতিলাম অমনি মুহূর্তের মধ্যেই মাতা যে আমাদের মুঠা ভরিয়া দিলেন। সেইজন্য আমি বিবেচনা করি অদ্যকার বাংলাভাষার দল যদি গদিটা দখল করিয়া বসে তবে আর-সকলকে সেটুকু স্বীকার করিয়া যাইতে হইবে। মনে রাখিতে হইবে এই মিলনোৎসবের ‘বন্দেমাতরং’ মহামন্ত্রটি বঙ্গসাহিত্যেরই দান।

এ কথা বিশেষরূপে মনে রাখিবেন যে, সাহিত্যই মানুষের যথার্থ মিলনের সেতু। কেন যে, তাহার কারণ এখানে বিবৃত করিয়া বলা অপ্রাসঙ্গিক হইবে না।

আমাদের দেশে বলিয়াছেন: বাক্যং রসাত্মকং কাব্যম্‌। রসাত্মক বাক্যই কাব্য। বস্তুত কাব্যের সংজ্ঞা আর-কিছুই হইতে পারে না। রস জিনিসটা কী? না যাহা হৃদয়ের কাছে কোনো-না-কোনো ভাবে প্রকাশ পায় তাহাই রস, শুদ্ধজ্ঞানের কাছে যাহা প্রকাশ পায় তাহা রস নহে। কিন্তু সকল রসই কি সাহিত্যের বিষয়? তাহা তো দেখিতে পাই না। ভোজনব্যাপারে যে সুখসঞ্চার হয় তাহার মতো