পরিশিষ্ট
তুষারশীর্ষ কাঞ্চনজঙ্ঘার মতো সকলের উর্ধ্বে মস্তক সমুন্নত রাখিতেন।

এই আশ্রমই আমাদের নিকট তাঁহার সর্বশ্রেষ্ঠ দান। বাহিরের কলকোলাহল হইতে দূরে অবস্থিত হইলেও মানুষের অন্তরতম কল্যাণ চিন্তা করা ইহার কাজ। শান্তিনিকেতন আশ্রমের পরিকল্পনা ও প্রতিষ্ঠার ভিতর দিয়া তাঁহার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যবোধ ও জীবনের অন্তর্নিহিত সত্যোপলব্ধির পরিচয় পরিস্ফুট হইয়া উঠিয়াছে। মিথ্যা ভবিষ্যদ্‌বাণীর দ্বারা তিনি কখনো কাহাকেও প্রতারিত করিতেন না। কোনো অবস্থাতেই তিনি শাশ্বত আনন্দে তাঁহার যে অবিচল বিশ্বাস ছিল তাহা ক্ষুন্ন হইতে দিতেন না। তিনি জানিতেন যে, বন্ধন মুক্তি ব্যতীত আত্মোন্নতি সম্ভবপর নহে। তিনি এই আশ্রমের ভিতরে সেই মুক্তির ভাব সঞ্চারিত করিয়া গিয়াছেন। কৃত্রিম বন্ধনে সত্য যাহাতে শৃঙ্খলিত না হয় তজ্জন্য আমার যথাশক্তি চেষ্টা আমি করিয়াছি। আমার পিতার ন্যায় আমিও বিশ্বাস করি যে স্বাধীনভাবে পরিবর্ধিত হইবার সুযোগ না পাইলে আত্মা বা মন কখনো চরম সার্থকতা লাভ করিতে পারে না। আমি তাঁহার নিকট আমার ঋণের কথা কখনো বিস্মৃত হইতে পারি না। কারণ মানুষের ব্যক্তিত্বকে শ্রদ্ধা করিতে এবং সত্যকে সকলের উপর স্থান দিতে তিনিই তাঁহার জীনবাদর্শ দ্বারা আমাকে শিখাইয়াছেন।

শান্তিনিকেতন    
২০ জানুয়ারি ১৯৩৬

 

দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর
অদ্য সকালে ঘুম ভাঙিলে চাহিয়া দেখি পূর্বাকাশ ঘন কৃষ্ণ মেঘে আচ্ছন্ন। মনে হইল আবহাওয়ার বিপর্যয়ে বুঝি আজিকার আনন্দের বাধা ঘটিবে। তাহার পর চিন্তা আসিল, সত্যকার আনন্দ লাভ কত দুর্ঘট। এই প্রাত্যহিক বাস্তবতার জগতে আনন্দের উৎস খুঁজিয়া পাওয়া যায় না। আত্মার গভীরতর প্রদেশে ইহার স্থান। হয়তো ঈশ্বরেরই বিধান এই যে, সত্যকার আনন্দ পাইতে হইলে মানুষকে নিজেরই অন্তরে ইহার উৎস খুঁজিতে হইবে।

মানুষ এই জগতে বহু অক্ষমতা লইয়া আসিয়াছে। দুর্ভাগ্যক্রমে আজ জগতের আর আর প্রাণীর মতো হিংস্রতা ও জড়তার মাত্রা তাহারও মধ্যে পুরোপুরিই রহিয়াছে। এই দুর্লঙ্ঘ্য বাধা অতিক্রম করিয়া, আত্মার স্বভাবসিদ্ধ অন্তর্নিহিত শক্তির বিকাশ সাধন করাই মানুষের জীবনের ব্রত বলিয়া বোধ হয়। আমি মনে করি, আজিকার আকাশপটে উজ্জ্বল অক্ষরে এই সত্যই লিখিত রহিয়াছে। মানুষকে এই অন্ধকারের যবনিকা ছিঁড়িয়া ফেলিতে হইবে এবং তাহার হৃদয়ের গভীর প্রদেশে যে জীবন ও আলোক নির্ঝর রহিয়াছে, তাহা আবিষ্কার করিতে হইবে।

আজ আমার পূজনীয় পিতৃদেবের কথা মনে পড়িতেছে— সারা জীবন ধরিয়া ঐকান্তিক তীব্রতা-সহকারে তিনি এই অন্ধকার ও মৃত্যুকে জয় করিবার চেষ্টা করিয়াছেন। এই জগতের অপূর্ণতা হইতে মুক্তিলাভ করিবার জন্য তিনি অমৃতের অনুসন্ধান করিয়াছেন। তাঁহার বিপুল পার্থিব সম্পদ তাঁহাকে বাঁধিয়া রাখিতে পারে নাই। বিলাসিতা ও সাচ্ছন্দ্য তাঁহাকে আত্মপ্রসাদ ও আরামের অভিশপ্ত জীবনের মধ্যে বদ্ধ করে নাই। জীবনের এই বৃহত্তর লক্ষ্যের অনুসন্ধানে রত ছিলেন বলিয়াই যেদিন দারিদ্র্যের রূঢ় আঘাত ভূমিকম্পের আকস্মিকতার মতো তাঁহার উপর আসিয়া পড়িল, তখন তাহা তিনি সহ্য করিতে পারিয়াছিলেন। সর্বোপরি তাঁহার ছিল সেই আধ্যাত্মিক নিরাসক্তি বাহ্য ঘটনায় যাহা এতটুকুও বিচলিত হইত না। ঐশ্বর্যের গুরুভারমুক্ত তাঁহার হৃদয় ত্যাগের আনন্দ উপলব্ধি