পরিশিষ্ট
পঞ্চম জর্জ
এত অকস্মাৎ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের উপর যে শোকভার নিপতিত হইয়াছে, আমরা সকলেই তাহার অংশ গ্রহণ করিতেছি। সম্রাট পঞ্চম জর্জের এই পরলোকগমন ব্রিটিশ প্রজামণ্ডলীর নিকট কেবল একটা ক্ষতি নহে, তদপেক্ষাও অধিক। কেননা সমগ্র জগৎ আজ একজন প্রকৃত বিশ্বশান্তিকামীকে হারাইল।
শান্তিনিকেতন     
২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৬

 

দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর
বাল্যকাল হইতে একটা জিনিস আমি বিশেষ করিয়া লক্ষ্য করিয়াছি যে অসংখ্য কর্মের ভিতরেও আমার পিতা নিজেকে আশ্চর্যরূপে স্বতন্ত্র করিয়া রাখিয়াছেন। এই শক্তি লইয়াই তিনি জন্মিয়াছিলেন— তাঁহার চরিত্রের ইহাই ছিল প্রধান বৈশিষ্ট্য। সাংসারিক প্রয়োজন, ঐশ্বর্যের আড়ম্বর, ভালোবাসা ও বন্ধুত্বের আকর্ষণ কিছুতেই তাঁহার চিত্তের প্রশান্তি ক্ষুন্ন করিতে পারিত না। মনে হইত যেন তাঁহার অন্তরের গভীরতম প্রদেশে এক অফুরন্ত শান্তির উৎসের সন্ধান তিনি পাইয়াছিলেন, তাহাতেই ইঁহাকে এই নিঃসঙ্গতা ও স্বতন্ত্রতার অধিকারী করিয়াছিল। যখন আমার পিতামহ পরলোক গমন করেন, তখন তিনি প্রায় বিনাশের পথে আসিয়া দাঁড়াইয়াছিলেন। কিন্তু তখনও তিনি বীরের মতো ঐহিক ও সাংসারিক সমস্ত জিনিসের প্রতি একটা অনাসক্তি বজায় রাখিয়াছিলেন, আত্মার ভিতরেই তখন তিনি সান্ত্বনার সন্ধান পাইয়াছিলেন।

আমার দশ বৎসর বয়স অতিক্রান্ত হইলে পিতার সহিত হিমালয় প্রবাসে যাইবার সুযোগ আমার মিলিয়াছিল। ইহার পূর্বে এত ঘনিষ্টভাবে তাঁহার সংস্পর্শে আসিবার আমার হয় নাই। তিনি নির্জনবাস হইতে যখন মাঝে মাঝে গৃহে আসিতেন, তখন আমি এবং পরিবারের অন্যান্য সকলেই তাঁহাকে ভীতি ও শ্রদ্ধামিশ্রিত দৃষ্টিতে দেখিতাম। তিনি আমাকে তাঁহার সঙ্গে লইয়া যাওয়ার প্রস্তাব যখন করিলেন, তখন আমার যে আনন্দ হইয়াছিল তাহা বর্ণনা করা যায় না। হিমালয়ে যাইবার পথে আমরা কয়েকদিন শান্তিনিকেতনে ছিলাম। সেইখানেই তাঁহার নিকট আমার প্রথম শিক্ষা আরম্ভ হয়। ইহা ৬৫ বৎসর পূর্বের কথা। এখনকার মতো তখনও আমি লেখাপড়ায় উদাসীন ছিলাম। বর্তমানে যেখানে নাট্যঘর নির্মিত হইয়াছে, ওইখানে একটি নারিকেল গাছ ছিল। তাহার ছায়ায় বসিয়া আমি প্রথম কবিতার বই লিখি। আমার বালকোচিত খেয়ালে পিতা কখনো বাধা দিতেন না কিন্তু অতি ঘনিষ্টভাবে তাঁহার সহিত মিশিবার সুযোগ পাইয়াও, এ কথা আমি সর্বদাই অনুভব করিতাম যে, তাঁহার আত্মা নক্ষত্রের মতো এক স্বতন্ত্র ঊর্ধ্বলোকে বিরাজ করিত। আমি এখনকার মতো তখনও বুঝিতাম যে, তিনি যখন ধ্যানমগ্ন হইতেন, তখন তিনি নিজের ভিতরে ডুবিয়া যাইতেন, অন্তরের সহিত তাঁহার যোগ সংস্থাপিত হইত। হিমালয়ে যখন তিনি পূর্বাস্য হইয়া ধ্যানে বসিতেন তখন স্বর্গীয় জ্যোতিতে উদ্ভাসিত তাঁহার প্রশান্ত মুখমন্ডল নিরীক্ষণ করিয়া আমার মনে যে ভীতি ও শ্রদ্ধার উদয় হইত, তাহা এখনও আমার স্মৃতিতে জাগরূক রহিয়াছে। যাঁহারা তাঁহাকে জানিতেন ও শ্রদ্ধা করিতেন, তাঁহারা এই প্রশস্তি ও বৈরাগ্যের মহিমা অনুভব করিয়াছেন। সৌর জগতে সূর্যের মতো তিনি তাঁহার আত্মীয়-বন্ধুদের মধ্যে বিরাজ করিতেন। সকলের অতি নিকটে থাকিয়াও তিনি