প্রকল্প সম্বন্ধেপ্রকল্প রূপায়ণেরবীন্দ্র-রচনাবলীজ্ঞাতব্য বিষয়পাঠকের চোখেআমাদের লিখুনডাউনলোডঅন্যান্য রচনা-সম্ভার |
যখন কোনো প্রবল সংঘর্ষে, কোনো নূতন শিক্ষায় একটা জাতি জাগ্রত হইয়া উঠে, তখন সে নিজেরই মধ্যে শক্তি সন্ধান করে। সে জানে যে, ধার করিয়া চলে না। যদি পৈতৃক ভাণ্ডারে মূলধন থাকে তবেই বৃহৎ বানিজ্য এবং লক্ষীলাভ, নতুবা চিরদিন উঞ্ছবৃত্তি।
আমাদের সংস্কার ও শিক্ষা এত দীর্ঘকালের, তাহা আমাদিগকে এমন জটিল বিচিত্র ও সুদৃঢ় ভাবে জড়িত করিয়া রাখিয়াছে, যে, বৃহৎ জাতিকে চিরকালের মতো তাহার বাহিরে লইয়া যাওয়া কাহারও সাধ্যায়ত্ত নহে। সেই চিরোদ্ভিন্ন ভারতবর্ষীয় প্রকৃতির মধ্য হইতেই আমাদের অভ্যুত্থানের উপাদান সংগ্রহ করিতে হইবে। আমরা ধুমকেতুর মতো দুই-চারিজন মাত্র গর্ববিস্ফারিতপুচ্ছে লঘুবেগে সাহেবিয়ানার দিকে ছিটকিয়া যাইতে পারি, কিন্তু সমস্ত দেশের পক্ষে তেমন লঘুত্ব সম্ভবপর নহে।
অতএব এক দিকে আমাদের দেশীয়তা, অপর দিকে আমাদের বন্ধনমুক্তি, উভয়ই আমাদের পরিত্রাণের পক্ষে অত্যাবশ্যক। সাহেবি অনুকরণ আমাদের পক্ষে নিষ্ফল এবং হিঁদুয়ানির গোঁড়ামি আমাদের পক্ষে মৃত্যু।
মহাত্মা দয়ানন্দ স্বামীর প্রতিষ্ঠিত আর্যসমাজ ক্ষুদ্র হিঁদুয়ানিকে আর্য-উদারতার দিকে প্রসারিত করিবার যে প্রয়াস পাইতেছেন এবং উত্তরপশ্চিমাঞ্চলে তাহা যেরূপ পরিব্যাপ্ত হইতেছে তাহাতে আমরা মহৎ-আশার কারণ দেখিতেছি।
উক্ত সমাজের, অন্তত সমাজস্থাপয়িতা দয়ানন্দ স্বামীর প্রচারিত মতের প্রধান গুণ এই যে, তাহা দেশীয়তাকেও লঙ্ঘন করে নাই, অথচ মনুষ্যত্বকেও খর্ব করে নাই। তাহা ভাবে ভারতবর্ষীয়, অথচ মতে সার্বভৌমিক। তাহা হৃদয়ের বন্ধনে আপনাকে প্রাচীন স্বজাতির সহিত বাঁধিয়াছে, অথচ উন্মুক্ত যুক্তি এবং সত্যের দ্বারা সর্বকালের সহিত সম্পর্ক স্থাপন করিয়াছে।
এই সমাজের সমস্ত লক্ষণগুলি পর্যালোচনা করিয়া আমরা আশা করিতেছি যে, ইহা ভারতে আর-একটি অভিনব সম্প্রদায় রূপে নূতন বিচ্ছেদ আনয়ন না করিয়া সমস্ত সম্প্রদায়কে ক্রমশ এক করিতে পারিবে।
বারান্তরে আর্যসমাজ সম্বন্ধে বিস্তারিত আলোচনা করিবার ইচ্ছা রহিল।
ভিন্ন জাতির সহিত সংস্রব ইংরাজের যেমন ঘটিয়াছে এমন আর-কোনো য়ুরোপীয় জাতির ঘটে নাই। কিন্তু ইংরাজের পরজাতিবিদ্বেষ সমান সুতীব্র রহিয়াছে। ইহা তাহাদের জাতীয়তার অত্যুগ্র বিকাশের পরিচয়স্থল।
বিদেশ হইতে আগত বিজাতি ইংলন্ডে অথবা ইংরাজ-উপনিবেশে বাসগ্রহণে উদ্যত হইলে ইংরাজের মনে যে বিরোধভাবের উদ্রেক করে স্পেক্টেটর সেই সম্বন্ধে আলোচনা উত্থাপিত করিয়াছেন।
কিন্তু পরদেশে গিয়া তদ্দেশীয়দের প্রতি ইংরাজের উদ্ধত বিমুখ ভাবও সুবিখ্যাত। এমন-কি, য়ুরোপের মহাদেশবাসীগণ সম্বন্ধেও ইহার অন্যথা হয় না।
আহারবিহারে আচারে ও ভাবে দ্বীপবাসী ইংরাজের সহিত মহাদেশবাসী য়ুরোপীয়ের স্বল্পই প্রভেদ, কিন্তু সেই প্রভেদগুলিও সাধারণ ইংরাজের মনে অবজ্ঞা এবং প্রতিকূল ভাব আনয়ন করে। তাহাদের জাতিসংস্কার এত দৃঢ় এবং সুকঠিন।
ইহার উপরে যখন পরজাতির সহিত স্বার্থের সংঘর্ষ জন্মিবার লেশমাত্র সম্ভাবনা ঘটে তখন ইংরাজের অসহিষ্ণুতা যে অত্যন্ত বর্ধিত হইবে ইহা স্বাভাবিক।
ইংলন্ড-প্রবাসী জর্মান ইতালীয় ও পোলীয় ইহুদিগণের প্রতি ইংরাজ অধিবাসীদের মনে যে শত্রুতার উদ্রেক করে তাহা যে কেবলমাত্র সুমহৎ জাতীয়ভাবের প্ররোচনায় তাহা বলিতে পারি না, উহার মধ্যে স্বার্থহানির আশঙ্কাই প্রবলতর।
একে বিজাতীয়, তাহার উপরে স্বার্থের সংঘর্ষ— এইরূপ স্থলে খৃস্টীয় ধর্মনীতি এবং ন্যায়-অন্যায়ের উচ্চতর আদর্শ টেকাই কঠিন হয়। ইহাতে যে অন্ধতা আনয়ন করে, ঊনবিংশ শতাব্দীর সভ্যতারশ্মি তাহা ভেদ করিয়া উঠিতে পারে না।
অল্পদিন হইল ভূতপূর্ব ভারত-স্টেট-সেক্রেটারি সার হেন্রি ফাউলার পার্লামেন্টে বলিয়াছিলেন 'ওআরেন হেস্টিংস্ এবং লর্ড্ ক্লাইভের কার্যবিধি যদি পার্লামেন্টের বিচারাধীন হইত তবে সম্ভবত ভারতসাম্রাজ্য আমরা পাইতাম না।' তাঁহার এই বাক্যে পার্লামেন্টে খুব-একটা উৎসাহসূচক করতালি পড়িয়াছিল।