পরিশিষ্ট

এ কথাটার কি এই অর্থ যে, যেখানে স্বার্থ স্বজাতির এবং দুঃখ পরজাতির সেখানে অবিচার-আচার করিলে চলে না? পার্লামেন্টের মতো প্রকাশ্য বৃহৎ সভায় এ কথার উচ্ছ্বসিত অনুমোদন কি ধর্মনীতির মূলসূত্রের প্রতি সুস্পষ্ট অবজ্ঞা-প্রদর্শন নহে।

ধর্মনীতির প্রতি এই অবজ্ঞা পরজাতির প্রতি সুগভীর অবজ্ঞা হইতেই প্রসূত। ক্লাইভ ও হেস্টিংস্‌ যাহাদের প্রতি প্রতারণা মিথ্যাচার ও নিদারুণ উপদ্রব করিয়াছিলেন তাহারা অনাত্মীয়, তাহারা কেহই নহে, এ কথা পার্লামেণ্টের সদস্যবর্গের মনের মধ্যে অন্তত অস্পষ্টভাবেও ছিল।

সাধারণত ধর্মনীতিবোধ তাঁহাদের যে অল্প তাহা বলিতে সাহস হয় না। কারণ, বল্‌গেরীয় ও আর্মানিদের প্রতি তুরস্কের অত্যাচার, ক্যুবান্‌দের প্রতি স্পেনের কঠোরতা সম্বন্ধে পার্লামেণ্টের সভ্যগন প্রবলপক্ষের প্রতি উৎসাহ-করতালি বর্ষণ করে না। কিন্তু ভারতবর্ষীয়ের প্রতি হেস্টিংসের ব্যবহার সম্বন্ধে তাঁহাদের নীতিবোধ যে এমন সহসা সবেগে বিপর্যস্ত হইয়া যায় তাহার কারণ স্বার্থজনিত অন্ধতা এবং পরজাতি– বিশেষত প্রাচ্য পরজাতির প্রতি তাঁহাদের স্বাভাবিক সুগভীর অবজ্ঞাপরতা।

যে অবজ্ঞা ফাউলার-সাহেবকে প্রকাশ্য স্পর্ধার সহিত নির্লজ্জ নীতিবিরুদ্ধ বাক্য বলাইয়াছে সেই র্স্পধা এবং সেই অবজ্ঞাই ভারতবর্ষীয় পাখাকুলিদের সম্বন্ধে কালস্বরূপ, সেই অবজ্ঞাই সমস্তিপুরে দরিদ্রের বিবাহ-উৎসবে হত্যাকাণ্ডের হাহাকার তুলিয়াছিল, সেই অবজ্ঞাই গোরা-বিভীষিকা-গ্রস্ত মারীপীড়িত দুর্ভাগাগণের অন্তিম অনুনয় হইতেও কর্তৃপুরুষদিগকে বধির করিয়া রাখিয়াছিল।

ইংরাজের নীতিবোধ এইরূপে দ্বিখন্ডিত হইয়া গিয়াছে। সেইজন্য স্বজাতি-বিজাতির মধ্যে অভিযোগ উপস্থিত হইলে বিচার করা তাঁহাদের পক্ষে সুকঠিন। কারণ, ইহা অসম্ভব নহে যে, যে ইংরাজ ফস্‌ করিয়া ঘুষা লাথি অথবা গুলি চালাইয়া ভারতবর্ষীয় জনসংখ্যা হ্রাস করিতে কুন্ঠিত হয় নাই স্বজাতিসমাজের সে শুভ্র মেষশাবকবিশেষ; অতএব একজন দেশী হত্যাকারীকে ইংরাজের যেরূপ খুনী বলিয়া মনে হয়, তাহাকে সেরূপ খুনী বলিয়া মনেই হয় না– সুতরাং এমন লোকটাকে ফাঁসি দেওয়া একটা আইনসংগত হত্যাকাণ্ড বলিয়া জ্ঞান হইতে পারে।

আমাদের প্রতি চাঁদের কলঙ্কের দিকটা ফেরানো আছে, কিন্তু তাহার বিপরীত পৃষ্ঠটা হয়তো সম্পূর্ণ নিষ্কলঙ্কভাবে নিজের নিকট দেদীপ্যমান– অতএব ঠিক কলঙ্কের বিচার করিতে হইলে একেবারে আমাদের তরফে আসিয়া দাঁড়াইতে হয়, কিন্তু তাহার মতো দুঃসাধ্য কাজ আর নাই।

ওআরেন হেস্টিংস্‌ লর্ড্‌ ক্লাইভ পরজাতির সম্বন্ধে যেমনই হোন, স্বজাতির সম্বন্ধে তাঁহারা মহৎ। ইংরেজ কবি হুড জিরাফ-জন্তুকে লক্ষ্য করিয়া বলিয়াছেন–

    “So very lofty in thy front–but then

So dwindling at the tail!”

অর্থাৎ, সম্মুখের দিকে তুমি এত সমুচ্চ, কিন্তু তবু লাঙ্গুলের দিকে এতই খর্ব! ইংরাজ-জিরাফের লাঙ্গুলের দিকটা পরজাতির দিকে পড়িয়াছে বলিয়া যে তাহার স্ব-জাতি তাহাকে সেই দিকেই পরিমাপ করিবে ইহা কখনো সম্ভবপর হইতে পারে না।

কিন্তু পররাজ্য অধিকার করিয়া স্বজাতি ও বিজাতিকে এক ন্যায়দণ্ডে তুলিত করিবার কঠিন অধিকার ইংরাজ স্বহস্তে গ্রহণ করিয়াছেন। সুতরাং স্বার্থের অনুরোধে সেই ন্যায় হইতে ভ্রষ্ট হইলে তাহাতে উৎসাহকরতালি-বর্ষনের কোনো কারণ দেখি না। তাহা স্বাভাবিক হইতে পারে, কিন্তু তাহাতে স্পর্ধাপ্রকাশের বিষয় লেশমাত্র নাই।

ইংরাজের এই পরবিদ্বেষ, বিশেষত প্রাচ্যবিদ্বেষ, নেটাল অস্ট্রেলিয়া প্রভৃতি উপনিবেশে কিরূপ নখদন্ত বিকাশ করিয়া উঠিয়াছে তাহা কাহারও অগোচর নাই। অথচ ইহাও দেখা যাইতেছে, ইংরাজ ভারতবর্ষীয় সৈন্যকে আফ্রিকার দুর্গম অরণ্যের মধ্যে রক্তপাত করাইতে কুন্ঠিত নহেন। তখন, এক রাজ্ঞীর প্রজা, এক সাম্রাজের অধিবাসী, এমন-সকল সৌভ্রাত্র্যমধু-মাখা কথা শুনা যায়।