পরিশিষ্ট
হইয়াছে, যাহাদিগকে আমরা কিছুতেই খেদাইয়া রাখিতে পারি নাই, আমাদের বেড়া-দেওয়া উদ্যানের মধ্যে যে-সকল আগাছা আপনি আসিয়া প্রবেশ করিয়াছে, তাহারা ক্রমে অনবধান অথবা অভ্যাসের জড়ত্ব-বশত আমাদের সহিত এক হইয়া গেছে। দুর্ভাগ্যক্রমে তাহারা কী শারীরসংস্থানে কী বুদ্ধিবৃত্তিতে আর্যদের সশ্রেণীয় বা সমকক্ষ নহে। তাহারা সর্ববিষয়েই নিকৃষ্ট। এই কারণে তাহারা আর্যসভ্যতায় বিকার উৎপাদন না করিয়া থাকিতে পারে না। তাহারা যেমন আর্যরক্তের বিশুদ্ধতা নষ্ট করিয়াছে তেমনি আর্যধর্ম আর্যসমাজকেও বিকৃত করিয়া দিয়াছে।

এই বহু দেবদেবী, বিচিত্র পুরাণ এবং অন্ধলোকাচার-সংকুল আধুনিক বৃহৎ বিকারের নাম হিন্দুত্ব।

কিন্তু আমাদের এই বিকারের জন্য তত ক্ষোভ নাই বিচ্ছেদের জন্য যত। এক্ষণে ধর্মে আচারে বিশ্বাসে ও শিক্ষায় ব্রাহ্মণ-অব্রাহ্ণণের মধ্যে ভেদ ক্ষীণপ্রায় হইয়া আসিয়াছে, বহুকালের সংঘর্ষে পরস্পরের মধ্যে অনেক অদলবদল হইয়া আর্য অনার্যতর এবং অনার্য আর্যতর ভাবে এক হইয়া আসিয়াছে। যাহা হইবার তাহা হইয়া গেছে। কিন্তু তবু বিচ্ছেদ ভাঙে না।

অর্থাৎ, ঐক্যের যা ক্ষতি তাহাও ঘটিয়াছে এবং অনৈক্যের যা দোষ তাহাও বর্তমান।

এক্ষণে এই দুটাই সংশোধন করা আমাদের কাজ। নতুবা আমাদের উন্নতির ভিত্তি দৃঢ় হইবে না। নতুবা আমাদের শিক্ষা মিথ্যা, আমাদের আন্দোলন নিষ্ফল, আমাদের কন্‌গ্রেস কন্ফারেন্স প্রভৃতি সমস্তই ক্ষনকালের ক্ষীণ উদ্যম।

এক্ষণে যিনি জড়ীভূত হিন্দুজাতির মধ্যে আচারে ব্যবহারে সমাজে ধর্মে আর্যভাবের একটি বিশুদ্ধ আদর্শ স্থাপন এবং কৃত্রিম ক্ষুদ্র নিরর্থক বিচ্ছেদগুলি দূর করিয়া সমগ্র লোকস্তূপের মধ্যে একটি সজীব ঐক্য সঞ্চার করিয়া দিবেন তিনিই ভারতবর্ষের বর্তমান কালের মহাপুরুষ।

পূর্বেই বলিয়াছি, রাষ্ট্রতন্ত্রীয় একতা আমাদের ছিল না। শত্রুকে আক্রমণ, শত্রুর আক্রমণ হইতে আত্মরক্ষা এবং এক শাসনতন্ত্রের অধীনে পরস্পরের স্বার্থ ও শুভাশুভের একত্ব অনুভব আমরা কখনো দীর্ঘকাল করি নাই। আমরা চিরদিন খণ্ড খণ্ড দেশে খণ্ড খণ্ড সমাজের সংকীর্ণ প্রাদেশিকতা-দ্বারা বিভক্ত। আমাদের স্থানীয় আচার, স্থানীয় বিধি, স্থানীয় দেবদেবীগণ বাহিরের আক্রমণ ও সংশোধন হইতে নিরাপদভাবে সুরক্ষিত হইয়া এক দিকে ক্ষুদ্র অসংগত, অন্য দিকে প্রবল পরাক্রমশালী হইয়া উঠিয়াছে। আমাদের ভিতরকার অনার্যতা, অদ্ভুত লোকাচার ও অন্ধ সংস্কারে শাখাপল্লবিত হইয়া আমাদিগকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জঙ্গলে পরিবৃত করিয়া রাখিয়াছে, সর্বসাধারণ মানবজাতির রাজপথকে আমাদের নিকট হইতে অবরুদ্ধ করিয়াছে। আমরা প্রাদেশিক, আমরা পল্লীবাসী; বৃহৎ দেশ ও বৃহৎ সমাজের উপযোগী মতের উদারতা, প্রথার যুক্তিসংগতি এবং সাধারণ স্বার্থরক্ষার উদ্‌যোগপরতা আমাদের মধ্যে নাই। এক কথায় বৃহৎক্ষেত্রে জীবনযাত্রা নির্বাহ করিবার যে সফলতা তাহা আমরা লাভ করিতে পারি নাই। এক্ষণে ইংরাজ রাজত্বে আমরা পরস্পর নিকটবর্তী হইয়াছি। এক্ষণে আমাদের প্রাদেশিক বিচ্ছেদগুলি ভাঙিয়া ফেলিবার সময় হইয়াছে। বহুদিনের বিরোধ-দ্বন্দ্বের মধ্যে যে-একটি প্রাচীন ঐক্যগ্রন্থি আমাদের নাড়িতে নাড়িতে বাঁধিয়া গিয়াছে সেইটেকেই প্রবল করিয়া আমাদের স্থানীয় এবং সাময়িক অনৈক্যগুলিকে ক্ষুদ্র কোণজাত ধুলার মতো ঝাড়িয়া ফেলিতে হইবে।

বর্তমান কালে হিঁদুয়ানির পুনরুত্থানের যে-একটা হাওয়া উঠিয়াছে তাহাতে সর্বপ্রথমে ঐ অনৈক্যের ধুলা, সেই প্রাদেশিক ও ক্ষনিক তুচ্ছতাগুলিই উড়িয়া আসিয়া আমাদিগকে আচ্ছন্ন করিয়াছে। কারণ, সেইটেই সর্বাপেক্ষা লঘু, এবং সেইটেই অল্প ফুৎকারে আকাশ পরিপূর্ণ করিয়া তুলিতে পারে।

কিন্তু এ ধুলা কাটিয়া যাইবে, আমাদের নিশ্বাসবায়ু বিশুদ্ধ হইবে, আমাদের চারি দিকের দৃশ্য উদ্‌ঘাটিত হইবে— সন্দেহমাত্র নাই। আমাদের দেশের যাহা স্থায়ী, যাহা সারবান্‌, যাহা গভীর, যাহা আমাদের সকলের ঐক্যবন্ধনের উপায়, তাহাই ক্রমে প্রকাশিত হইয়া পড়িবে।