পরিশিষ্ট

জগতে হিন্দুজাতি এক অপূর্ব দৃষ্টান্ত। ইহাকে বিশেষ জাতি রূপে গণ্য করা যায় এবং যায়ও না। জাতীয়ত্বের সংকীর্ণতা ইহার মধ্যে আছে অথচ জাতীয়ত্বের বল ইহার মধ্যে নাই। ইহা এক অথচ অনেক, ইহা বিপুল অথচ দুর্বল। ইহার বন্ধন যেমন কঠিন তেমনি শিথিল, ইহার সীমা যেমন দৃঢ় তেমনি অনির্দিষ্ট।

য়ুরোপে জাতিগত উপাদানে রাজনৈতিক ঐক্যই সর্বপ্রধান। হিন্দুদের মধ্যে সেটা কোনোকালেই ছিল না বলিয়া যে হিন্দুরা জাতিবদ্ধ নহে, সে কথা ঠিক নহে।

বৈদিক সময় হইতে পৌরাণিক যুগ পর্যন্ত সুদীর্ঘকাল ধরিয়া শাস্ত্র এবং সংস্কার, আচার এবং অনুশাসন, হিন্দুদিগের জন্য এক বিরাট বিস্তৃত আবাসভবন নির্মাণ করিয়াছে। তাহার সকল কক্ষগুলি সমান নহে, মাঝে মাঝে দেয়াল উঠিয়া তাহার ভিন্ন ভিন্ন বিভাগের মধ্যে যাতায়াতের পথ রুদ্ধ হইয়াছে, কিন্তু তথাপি এই বিপুলতার মধ্যে একটা বৃহৎ ঐক্য আছে।

এই অট্টালিকার মধ্যে যাহারা আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছে তাহারা আদৌ এক-বংশীয় নহে। দক্ষিণের দ্রাবিড়ি হইতে হিমালয়ের নেপালি পর্যন্ত নানা বিচিত্র জাতি বহুকালে ক্রমে ক্রমে ইহার মধ্যে সম্মিলিত হইয়াছে।

বরঞ্চ যে-সকল জাতি মিশ্রিত হইয়া ইংরাজ-মহাজাতি রচিত হইয়াছে তাহারা মূলত ভিন্নগোত্রীয় নহে। কিন্তু হিন্দুদের মধ্যে বিসদৃশ-জাতি-পরম্পরা যেমন একত্র মিশ্রিত হইয়াছে জগতে এমন আর কুত্রাপি ঘটে নাই।

স্পেক্টেটর যে স্বাভাবিক পরজাতিবিদ্বেষের কথা বলিয়াছেন আদিম আর্যদের মধ্যে তাহা প্রচুরপরিমাণেই ছিল। আদানপ্রদান আচারবিচার, এমন-কি, জ্ঞানবিজ্ঞানচর্চায় তাঁহারা আপনাদিগকে অনার্যদের সংস্রব হইতে দূরে রক্ষা করিবার জন্য একান্ত চেষ্টা করিয়াছিলেন।

এ এক বহুদিনব্যাপী প্রকান্ড যুদ্ধ্ব। রামায়ণ-মহাভারতের সুবিশাল ছন্দঃস্রোতের মধ্যে এই প্রাণপণ যুদ্ধের প্রলয়কল্লোল এখনো ধ্বনিত হইতেছে।

কিন্তু চারি দিকের সহিত চিরকাল লড়াই করা চলে না। ক্রমে বিরোধচেষ্টা শিথিল হইয়া আসে এবং অল্পে অল্পে সন্ধি স্থাপিত হয়। এবং এইরূপে ধীরে ধীরে আর্য-অনার্যের মাঝখানের ব্যবধান ক্ষীয়মাণ হইয়া আসিল এবং ক্রমে অনার্যদের সংস্কার, তাহাদের পুজাবিধি, তাহাদের দেবতা অভিমানী আর্যাবর্তের মধ্যে প্রবেশ করিয়া তাহাকে আবর্তিত করিয়া তুলিল।

সেইজন্যই আজ হিন্দুজাতি জ্ঞানে অজ্ঞানে, আচারে অনাচারে, বিবেকে এবং অন্ধ কুসংস্কারে এমন একটা অদ্ভুত মিশ্রণ হইয়া দাঁড়াইয়াছে।

যদিচ সকল বিষয়েই আর্য-অনার্যের মধ্যবর্তী সীমা বিলুপ্তপ্রায় হইয়া আসিয়াছে, এমন-কি, আমাদের বর্ণ আকার আয়তনে রক্তমিশ্রণেরও সাক্ষ্য দিতেছে, তথাপি স্বাতন্ত্র্যরক্ষাজন্য বহুকালব্যাপী সেই যুদ্ধচেষ্টা আজিও হিন্দুসমাজের আদ্যন্তমধ্যে সজাগ হইয়া আছে।

তবে, পূর্বেকার সেই আর্য-অনার্যের সংগ্রাম অদ্য হিংস্র উগ্রতা পরিত্যাগ করিয়াছে বটে। কিন্তু তাহা পরিব্যাপ্ত হইয়া সমাজের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের মধ্যে বিচ্ছেদ আনয়ন করিয়াছে।

তাহার এক কারণ, আমাদের পরস্পরের মধ্যে বৈসাদৃশ্য এত অধিক যে, প্রকৃতির অনিবার্য নিয়মে যখন আমরা মিলিতেছিলাম তখনো শেষ পর্যন্ত আমাদের স্বাতন্ত্র্যচেষ্টার বিরাম ছিল না। আকর্ষণ এবং বিপ্রকর্ষণ কেহই সম্পূর্ণ হার মানিতে চাহে নাই।

এই কারণে যদিচ আমরা বহুসংখ্যক আর্য অনার্য এবং সংকর জাতি হিন্দুত্ব-নামক এক অপরূপ ঐক্য লাভ করিয়াছি, তথাপি আমরা বল পাই নাই। আমরা যেমন এক তেমনি বিচ্ছিন্ন।

এই দুর্বলতার প্রধাণ কারণ, আমরা অভিভূত ভাবে এক, আমরা সচেষ্ট ভাবে এক নহি। যাহারা আমাদের সহিত সংলগ্ন