প্রকল্প সম্বন্ধেপ্রকল্প রূপায়ণেরবীন্দ্র-রচনাবলীজ্ঞাতব্য বিষয়পাঠকের চোখেআমাদের লিখুনডাউনলোডঅন্যান্য রচনা-সম্ভার |
পূর্বদেশীয়দের এই নীরব সহিষ্ণুতা যাহাতে পশ্চিমদেশীয়দিগকে অলক্ষ্যে অসতর্কতা ও ঔদ্ধত্যে লইয়া যায়, ইহাই প্রাচ্য প্রজা ও পাশ্চাত্য রাজা উভয়েরই পক্ষে বিপদের মূল। ইহা হইতেই গোরা সৈন্যদের মজার খেলা ও কালা আদমিদের অকস্মাৎ উন্মত্ততার সৃষ্টি হয়।
যাহা হউক, এইরূপ সংঘটন এবং সংঘর্ষে প্রজাদের আন্তরিক সন্তাপ যে কিরূপ বাড়িয়া উঠিতেছে তাহা পরিমাণ করিবার উপায় নাই। যে-সকল ইংরাজ কথায় কথায় ঘুষা লাথি চড়, এবং 'শূয়র নিগর' সম্ভাষণ প্রয়োগ করিতে সর্বদা প্রস্তুত তাঁহারা প্রত্যহই ভারতবর্ষে কিপ্রকার বিপৎপাতের ভিত্তি রচনা করিতেছেন তাহা তাঁহারা জানেন না, এবং যে ইংরাজসমাজ এইরূপ রূঢ়তা ও অবজ্ঞাপরতার বিরুদ্ধে কোনোপ্রকার নৈতিক বাধা প্রদান করেন না তাঁহারা যে শাখায় বসিয়া আছেন সেই শাখা ছেদনে প্রবৃত্ত।
আমাদের প্রতি সাধারণ ইংরাজের এইপ্রকার ভাবই প্রজাবিদ্রোহের ভাব। তাঁহারা আচারে ব্যবহারে ভাষায় ভঙ্গিতে সর্বদাই আমাদের মর্মস্থানকে ক্ষুব্দ করিতেছেন। এমন-কি, তাঁহাদের মধ্যে এমন মূঢ়চেতারও অভাব নাই যাঁহারা অসহ্য অবজ্ঞার আঘাতে প্রজাহৃদয়ে অপমানক্ষত সর্বদা জাগাইয়া রাখাই রাজনৈতিক হিসাবে কর্তব্য জ্ঞান করেন। তাঁহারা পথে চলিতে চাবুক তুলিয়া সেলাম শিখাইতে শিখাইতে অগ্রসর হন।
ইহাকেই বলে প্রজাবিদ্রোহ এবং নিয়ত এই বিদ্রোহেই প্রজার হইয়া প্রজাপতির কালাগ্নি উত্তরোত্তর প্রজ্বলিত হইতে থাকে। ইংরাজ কি সেই চিরজাগ্রত প্রজাপালকের বিশ্বনিয়মের প্রতিও প্রভুত্বমদোদ্ধত ভ্রূকুটি নিক্ষেপ করিবেন। প্রজাদের সংবাদপত্র সভাসমিতি এবং বাগ্মীবর্গ আছে, রুদ্রমূর্তি রাজা মুহূর্তের মধ্যে তাহাদের বাগরোধ করিয়া দিতে পারেন; কিন্তু প্রজাপতির সভা নিঃশব্দ নীরব এবং তাঁহার বিচার সুচির কিন্তু সুনিশ্চিত।
পরজাতীয়ের প্রতি বিদ্বেষ যে স্বাভাবিক এবং কিয়ৎপরিমাণে তাহার সার্থকতা আছে এ সম্বন্ধে সম্প্রতি ইংরাজি স্পেক্টেটর পত্রে একটি প্রবন্ধ বাহির হইয়াছে।
একটা জাতি বাঁধিয়া তুলিতে অনেক সময় যায়। আজ যাহারা ইংরাজ-জাতি বলিয়া খ্যাত তাহারা জুলিয়স সীজরের আক্রমণকাল হইতে এড্ওঅর্ড্ দি কন্ফেসরের রাজত্বকাল পর্যন্ত হাজার বৎসর ধরিয়া পরিপাক পাইয়া তবে প্রস্তুত হইয়াছে।
এই সময়ের মধ্যে কেল্ট্ রোমান অ্যাঙ্গল জুট ডেন স্যাক্সন নর্মান প্রভৃতি বিচিত্র ভিন্ন জাতি এক ঐতিহাসিক চুল্লির উপরে চড়ানো ছিল। তাহাদের মধ্যে প্রভেদ ও বিরোধ ঘুচিয়া যখন তাহারা ঘনভাবে এক হইয়া উঠিল তখন তাহারা ব্রিটিশ-জাতিরূপে গণ্য হইল।
এত দীর্ঘকালনির্মিত জাতীয়তা পরের সংঘাত হইতে আপনাকে সর্বতোভাবে রক্ষা করিবার জন্য স্বভাবতই উদ্যত হইয়া থাকে। ধর্মনীতি সমাজনীতি অর্থনীতি সম্বন্ধে তাহার সংস্কারসকল এমন একান্ত বিশেষত্ব ও দৃঢ়তা লাভ করে যে, তাহার মধ্যে বহির্জাতির প্রবেশপথ থাকে না।
ভারতবর্ষের হিন্দুগণ বিশেষ একটি জাতি বলিয়া গণ্য হইতে পারে কি না তাহা লইয়া কেহ কেহ তর্ক উত্থাপন করেন। সে তর্ক অসংগত নহে।