মুক্তির উপায়

পুষ্প। তাই বুঝি ধরা দিতে এসেছ?

মাখন। না না, মনটা এখনো তত দূর পর্যন্ত শক্ত হয় নি। শেষে বিজ্ঞাপনদাতার খবর নিতে এসে যখন দেখলুম, ঠিকানাটা এই আঙিনারই সীমানার মধ্যে তখন প্রথমটা ভাবলুম বিজ্ঞাপনের মান রক্ষা করব, দেব এক লম্ফ। কিন্তু, রইলুম কেবল মজার লোভে। পণ করলুম শেষ পর্যন্ত দেখতে হবে। দিদি আমার,কেমন সন্দেহ হচ্ছে, কোনো সূত্রে বুঝি আমাকে চিনতে, নইলে অমন বিজ্ঞাপন তোমার মাথায় আসত না।

পুষ্প। তোমার আঁচিলওয়ালা নাকের খ্যাতি পাড়ার লোকের মুখে মুখে। তোমার বিজ্ঞাপন তোমার নাকের উপর। বিশ্বকর্মার হাতে এ নাক দুবার তৈরি হতে পারে না— ছাঁচ তিনি মনের ক্ষোভে ভেঙে ফেলেছেন।

মাখন। এই নাকের জোরে একবার বেঁচে গিয়েছি, দিদি। মট্‌‌‌‌‌‌রুগঞ্জে চুরি হল, সন্দেহ করে আমাকে ধরলে চৌকিদার। দারোগা বুদ্ধিমান; সে বললে, এ লোকটা চুরি করবে কোন্‌ সাহসে—নাক লুকোবে কোথায়। বুঝেছ, দিদি? আমার এ নাকটাতে ভাঁড়ামির ব্যাবসা চলে, চোরের ব্যাবসা একেবারে চলে না।

পুষ্প। কিন্তু, তোমার হাতে যে কলার ছড়াটা দেখছি ওটা তো আমার চেনা, কোনো ফিকিরে তোমার জুড়ি-অন্নপূর্ণার ঘর থেকে সরিয়ে নিয়েছ।

মাখন। অনেক দিনের পেটের জ্বালায় ওদের ভাঁড়ারে চুরি পূর্বে থেকেই অভ্যেস আছে।

পুষ্প। এত বড়ো কাঁদি নিয়ে করবে কী। হনুমানের পালার তালিম দেবে?

মাখন। সে তো ছেলেবেলা থেকেই দিচ্ছি। পথের মধ্যে দেখলুম এক ব্রহ্মচারী বসে আছেন পাকুড়তলায়। আমার বদ অভ্যাস, হাসাতে চেষ্টা করলুম— ঠোঁটের এক কোণও নড়াতে পারলুম না, মন্তর আউড়েই চলল। ভয় হল, বুঝি ব্রহ্মদত্যি হবে। কিন্তু, মুখ দেখে বুঝলুম উপোস করতে হতভাগা তিথিবিচার করছে না। ওর পাঁজিতে তিনটে চারটে একাদশী একসঙ্গে জমাট বেঁধে গেছে। জিজ্ঞাসা করলুম, বাবাজি, খাবে কিছু? কপালে চোখতুলে বললে, গুরুর কৃপা যদি হয়। মাঝে মাঝে দেখি মাথার নীচে পুঁথি রেখে নাক ডাকিয়ে ঘুমচ্ছেন, ডাকের শব্দে ও গাছের পাখি একটাও বাকি নেই। নাকের সামনে রেখে আসব কলার ছড়াটা।

পুষ্প। লোকটার পরিচয় নিতে হবে তো।

মাখন। নিশ্চয় নিশ্চয়। হাসতে হাসতে পেট ফেটে যাবে, আমার চেয়ে মজা।

পুষ্প। ভালো হল। হনুমানের সঙ্গে অঙ্গদ চাই। ওকে তোমারই হাতে তৈরি করে নিতে হবে। শেওড়াফুলির হাট উজাড় করে কলার কাঁদি আনিয়ে নেব।

মাখন। শুধু কলার কাঁদির কর্ম নয়।

পুষ্প। তা নয় বটে। যে কারখানায় তুমি নিজে তৈরি সেখানকার দুই-চাকাওয়ালা যন্ত্রের তলায় ওকে ফেলা চাই।

মাখন। দয়াময়ী, জীবের প্রতি এত হিংসা ভালো নয়।

পুষ্প। ভয় নেই, আমি আছি, হঠাৎ অপঘাত ঘটতে দেব না। আপাতত কলার ছড়াটা ওকে দিয়ে এসো।

মাখন। আমাদের দেশে মেয়েরা থাকতে সন্ন্যাসী না খেয়ে মরে না। কিন্তু, ও লোকটা ভুল করেছে—বৈরাগির ব্যাবসা ওর নয়, ওর চেহারায় জলুষ নেই। নিতান্ত নিজের স্ত্রী ছাড়া ওর খবরদারি করবার মানুষ মিলবে না।

পুষ্প। তোমার অমন চেহারা নিয়ে তুমি ছ বছর চালালে কী করে।

মাখন। ময়রার দোকানে মাছি তাড়িয়েছি, পেয়েছি বাসি লুচি তেলে-ভাজা, যার খদ্দের জোটে না। যাত্রার দলে ভিস্তি সেজেছি, জল খেতে দিয়েছেন অধিকারী মুড়কি আর পচা কলা। সুবিধে পেলেই মা মাসি পাতিয়ে মেয়েদের পাঁচালি শুনিয়ে দিয়েছি