রামমোহন রায়
রাজা রামমোহন রায়ের স্বরণার্থ সভায় ১২৯১ সালের ৫ মাঘে,
সিটি কলেজ গৃহে পঠিত

সাধারণত আমরা প্রতিদিন গুটিকতক ছোটো ছোটো কাজ লইয়াই থাকি; মাকড়সার মতো নিজের ভিতর হইতে টানিয়া টানিয়া আমাদের চারি দিকে স্বার্থের জাল নির্মাণ করি ও স্ফীত হইয়া তাহারই মাঝখানটিতে ঝুলিতে থাকি; সমস্ত জীবন দৈনন্দিন খুঁটিনাটির মধ্যে সমাহিত হইয়া অন্ধকার ও সংকীর্ণতার গর্ভে স্বচ্ছন্দসুখ অনুভব করি। আমাদের প্রতিদিন পূর্বদিনের পুনরাবৃত্তি মাত্র, আমাদের ক্ষুদ্র জীবন একটি ধারাবাহী উন্নতির কাহিনী নহে। সেই প্রতিদিবসের উদরপূর্তি, প্রতিরাত্রের নিদ্রা–বৎসরের মধ্যে এই ঘটনা ও ইহারই আনুষঙ্গিক অনুষ্ঠানগুলিরই তিনশো পঁয়ষট্টি বার করিয়া পুনরাবর্তন–এই তো আমাদের জীবন, ইহাতে আমাদের নিজের প্রতি শ্রদ্ধা হয় না–অহংকার ও আত্মাভিমানের অভাব নাই বটে, কিন্তু আপনাদের প্রতি যথার্থ শ্রদ্ধা নাই। একপ্রকার নিকৃষ্টজাতীয় জীবাণু অছে, সে কেবল গতিবিশেষ অবলম্বন করিয়া ঘুরিতেই জানে; সে সমস্ত জীবন একই ঘুরন ঘুরিতেছে। তাহার সহিত আমাদের বেশি প্রভেদ দেখিতে পাই না। আমাদের আহ্নিক গতি আছে, বার্ষিক গতি নাই–আমরা নিজের চারি দিকে ঘুরিতেছি, নিজের নাভিকুণ্ডল প্রদক্ষিণ করিতেছি, কিন্তু অনন্তজীবনের কক্ষপথে এক পা অগ্রসর হইতেছি না। এই পরম কৌতুকাবহ আত্মপ্রদক্ষিণ-দৃশ্য চতুর্দিকে দেখা যাইতেছে–সকলে মাটির উপরে বিন্দুমাত্র চিহ্ন রচনা করিয়া লাটিমের ন্যায় সূচ্যগ্র-পরিমাণ-ভূমির মধ্যেই জীবনের সুদীর্ঘ ভ্রমণ নিঃশেষ করিয়া দিতেছে। প্রতিদিন চারি দিকে ইহাই দেখিয়া মনুষ্যত্বের উপরে আমাদের বিশ্বাস হ্রাস হইয়া যায়, সুতরাং মনুষ্যত্বের গুরুতর কর্তব্য সাধন করিবার বল চলিয়া যায়। এইজন্য মহাত্মাদের প্রতি মাঝে মাঝে দৃষ্টিপাত করা আমাদের নিতান্ত আবশ্যক। মহাত্মাদের জীবন আলোচনা করিলে মনুষ্যত্ব যে কী তাহা বুঝিতে পারি, ‘আমরা মানুষ’ বলিলে যে কতখানি বলা হয় তাহা উপলব্ধি করিতে পারি, জানিতে পারি যে আমরা কেবল অস্থিচর্মনির্মিত একটা আহার করিবার যন্ত্র মাত্র নই, আমাদের সুমহৎ কুলমর্যাদার খবর পাইয়া থাকি। আমরা যে আমাদের চেয়ে ঢের বড়ো, অর্থাৎ মনুষ্য, সাধারণ মানুষদের চেয়ে যে অনেক পরিমাণে শ্রেষ্ঠ, ইহাই মনের মধ্যে অনুভব করিলে তবে আমাদের মাথা তুলিতে ইচ্ছা করে, মৃত্তিকার আকর্ষণ হ্রাস হইয়া যায়।

মহাপুরুষেরা সমস্ত মানবজাতির গৌরবের ও আদর্শের স্থল বটেন, কিন্তু তাঁহারা জাতিবিশেষের বিশেষ গৌরবের স্থল তাহার আর সন্দেহ নাই। গৌরবের স্থল বলিলে যে কেবলমাত্র সামান্য অহংকারের স্থল বুঝায় তাহা নহে, গৌরবের স্থল বলিলে শিক্ষার স্থল, বললাভের স্থল বুঝায়। মহাপুরুষদিগের মহৎকার্য-সকল দেখিয়া কেবলমাত্র সম্ভ্রমমিশ্রিত বিস্ময়ের উদ্রেক হইলেই যথেষ্ট ফললাভ হয় না–তাঁহাদের যতই ‘আমার’ মনে করিয়া তাঁহাদের প্রতি যতই প্রেমের উদ্রেক হয় ততই তাঁহাদের কথা, তাঁহাদের কার্য, তাঁহাদের চরিত্র আমাদের নিকট জীবন্ত হইয়া উঠে। যাহাদিগকে লইয়া আমরা গৌরব করি তাঁহাদিগকে শুদ্ধমাত্র যে আমরা ভক্তি করি তাহা নহে, তাঁহাদের ‘আমার’ বলিয়া মনে করি। এইজন্য তাঁহাদের মহত্ত্বের আলোক বিশেষরূপে আমাদেরই উপরে আসিয়া পড়ে, বিশেষরূপে আমাদেরই মুখ উজ্জ্বল করে। শিশু যেমন সহস্র বলবান ব্যক্তিকে ফেলিয়া বিপদের সময় পিতার কোলে আশ্রয় লইতে যায়, তেমনি আমরা দেশের দুর্গতির দিনে আর-সকলকে ফেলিয়া আমাদের স্বদেশীয় মহাপুরুষদিগের অটল আশ্রয় অবলম্বন করিবার জন্য ব্যাকুল হই। তখন আমাদের নিরাশ হৃদয়ে তাঁহারা যেমন বলবিধান করিতে পারেন এমন আর কেহই নহে। ইংলণ্ডের দুর্গতি কল্পনা করিয়া কবি ওআর্ডস্হওআর্থ্‌ পৃথিবীর আর-সমস্ত মহাপুরুষকে ফেলিয়া কাতর স্বরে মিল্টনকেই ডাকিলেন;