রামমোহন রায়
কহিলেন, ‘মিল্টন, আহা, তুমি যদি আজি বাঁচিয়া থাকিতে! তোমাকে ইংলণ্ডের বড়োই আবশ্যক হইয়াছে।’ যে জাতির মধ্যে স্বদেশীয় মহাপুরুষ জন্মান নাই সে জাতি কাহার মুখ চাহিবে–তাহার কী দুর্দশা! কিন্তু, যে জাতির মধ্যে মহাপুরুষ জন্মগ্রহণ করিয়াছেন কিন্ত তথাপিও যে জাতি কল্পনার জড়তা–হৃদয়ের পক্ষাঘাত-বশত তাঁহার মহত্ত্ব কোনোমতে অনুভব করিতে পারে না, তাহার কী দুর্ভাগ্য!

আমাদের কী দুর্ভাগ্য! আমরা প্রত্যেকেই নিজে নিজেকে মস্তলোক মনে করিয়া নিজের পায়ে পাদ্য-অর্ঘ্য দিতেছি, বাষ্পের প্রভাবে স্ফীত হইয়া লঘু হৃদয়কে লঘুতর করিয়া তুলিতেছি। প্রতিদিনকার ছোটো ছোটো মস্তলোকদিগকে, বঙ্গসমাজের বড়ো বড়ো যশোবুদ্‌বুদদিগকে, বালুকার সিংহাসনের উপর বসাইয়া দুই দিনের মতো পুষ্পচন্দন দিয়া মহত্ত্বপূজার স্পৃহা খেলাচ্ছলে চরিতার্থ করিতেছি, বিদেশীয়দের অনুকরণে কথায় কথায় সভা ডাকিয়া চাঁদা তুলিয়া মহত্ত্বপূজার একটা ভান ও আড়ম্বর করিতেছি। এজলাস হইতে জোন্‌স্‌ সাহেব চলিয়া গেলে হাটে তাহার ছবি টাঙাইয়া রাখি, জেম্‌স্‌ সাহেব আসিলে তাহার পায়ে পুষ্পমাল্য দিই। অর্থের, বিনয়ের, উদারতার অভাব দেখিতে পাই না। কেবল আমাদের যথার্থ স্বদেশীয় মহাপুরুষকেই হৃদয় হইতে দূরে রাখিয়া, তাঁহাকে সম্মান করিবার ভার বিদেশীদের উপরে অর্পণ করিয়া নিশ্চিন্ত মনে বসিয়া রহিয়াছি ও প্রতিদিন তিন বেলা তিনটে করিয়া নূতন নূতন মৃৎপ্রতিমা-নির্মাণে নিরতিশয় ব্যস্ত হইয়া আছি।

বর্তমান বঙ্গসমাজের ভিত্তি স্থাপন করিয়াছেন রামমোহন রায়। আমরা সমস্ত বঙ্গবাসী তাঁহার সম্পত্তির উত্তরাধিকারী, তাঁহার নির্মিত ভবনে বাস করিতেছি। তিনি আমাদের জন্য যে কত করিয়াছেন, কত করিতে পারিয়াছেন, তাহা ভালো করিয়া আলোচনা করিয়া দেখিলে তাঁহার প্রতি প্রগাঢ় ভক্তি ও স্বজাতির প্রতি বিশ্বাস জন্মিবে। আমাদিগকে যদি কেহ বাঙালি বলিয়া অবহেলা করে আমরা বলিব, রামমোহন রায় বাঙালি ছিলেন।

রামমোহন রায়ের চরিত্র আলোচনা করিবার আর-একটি গুরুতর আবশ্যকতা আছে। আমাদের এখনকার কালে তাঁহার মতো আদর্শের নিতান্ত প্রয়োজন হইয়াছে। আমরা কাতর স্বরে তাঁহাকে বলিতে পারি, ‘রামমোহন রায়, আহা, তুমি যদি আজ বাঁচিয়া থাকিতে! তোমাকে বঙ্গদেশের বড়োই আবশ্যক হইয়াছে। আমরা বাক্‌পটু লোক, আমাদিগকে তুমি কাজ করিতে শিখাও। আমরা আত্মম্ভরী, আমাদিগকে আত্মবিসর্জন দিতে শিখাও। আমরা লঘুপ্রকৃতি, বিপ্লবের স্রোতে চরিত্রগৌরবের প্রভাবে আমাদিগকে অটল থাকিতে শিখাও। আমরা বাহিরের প্রখর আলোকে অন্ধ, হৃদয়ের অভ্যন্তরস্থ চিরোজ্জ্বল আলোকের সাহায্যে ভালোমন্দ নির্বাচন করিতে ও স্বদেশের পক্ষে যাহা স্থায়ী ও যথার্থ মঙ্গল তাহাই অবলম্বন করিতে শিক্ষা দাও।

রামমোহন রায় যথার্থ কাজ করিয়াছেন। তাঁহার সময়ে প্রগল্‌ভা রসনার এত শ্রীবৃদ্ধি হয় নাই, সুতরাং তাহার এত সমাদরও ছিল না। কিন্তু আর-একটা কথা দেখিতে হইবে। এক-একটা সময়ে কাজের ভিড় পড়িয়া যায়, কাজের হাট বসিয়া যায়, অনেকে মিলিয়া হোহো করিয়া একটা কাজের কারখানা বসাইয়া দেন–তখন কাজ করিতে অথবা কাজের ভান করিতে একটা আমোদ আছে। তখন সেই কার্যাড়ম্বর নাট্যরস জন্মাইয়া মানুষকে মত্ত করিয়া তুলে, বিশেষত একটা তুমুল কোলাহলে সকলে বাহ্যজ্ঞান বিস্মৃত হইয়া একপ্রকার বিহ্বল হইয়া পড়েন। কিন্তু রামমোহন রায়ের সময়ে বঙ্গসমাজের সে অবস্থা ছিল না। তখন কাজেতে মত্ততাসুখ ছিল না; অত্যন্ত ব্যস্তসমস্ত হইবার, হাঁসফাঁস করিবার আনন্দ ছিল না; একাকী অপ্রমত্ত থাকিয়া ধীরভাবে সমস্ত কাজ করিতে হইত। সঙ্গিহীন সুগম্ভীর সমুদ্রের গর্ভে যেমন নীরবে অতি ধীরে ধীরে দ্বীপ নির্মিত হইয়া উঠে, তাঁহার সংকল্প তেমনি অবিশ্রাম নীরবে সুধীরে তাঁহার গভীর হৃদয় পরিপূর্ণ করিয়া কার্য-আকারে পরিস্ফুট হইয়া উঠিত। ব্যস্তসমস্ত চটুল স্রোতস্বিনীতে যেমন দেখিতে দেখিতে আজ চড়া পড়ে কাল ভাঙিয়া যায়–সেরূপ ভাঙিয়া গড়িয়া কাজ যত না হউক, খেলা অতি চমৎকার হয়–তাঁহাদের সেকালে সেরূপ ছিল না। মহত্ত্বের প্রভাবে, হৃদয়ের অনুরাগের প্রভাবে কাজ না করিলে, কাজ করিবার আর কোনো প্রবর্তনাই তখন বর্তমান ছিল না। অথচ কাজের ব্যাঘাত এখনকার চেয়ে ঢের বেশি ছিল। রামমোহন রায়ের যশের প্রলোভন কিছুমাত্র