রামমোহন রায়
তিনি দেখিলেন, জীবন আমাদের মধ্যে আচ্ছন্ন হইয়া আছে। তাহাকেই তিনি জাগ্রত করিয়া তুলিলেন। আমাদের চেষ্টা হউক, আমাদের এই জীবনকে সতেজ করিয়া তুলি–তবে আমরা ক্রমে বিদেশীয় সত্য আপনার করিতে পারিব। তাও যে সকল সময়ে সকল অবস্থায় সম্পূর্ণ করিতে পারিব, এমন ভরসা নাই। আমাদের জঠরানলেরও যেমন এমন সার্বভৌমিক উদারতা নাই যে সমস্ত খাদ্যকে সমান পরিপাক করিতে পারে, আমাদের হৃদয়েরও সেই দশা-কেী করা যায়, উপায় নাই। এইজন্যই বলি, প্রাচীন ঋষিদের উপনিষদের ব্রহ্মনাম উচ্চারণ করিয়া আগে আমাদের দেশে ঈশ্বরের সিংহাসন প্রতিষ্ঠা করিয়া লই, তাহার পরে সার্বভৌমিকতার দিকে মনোযোগ দেওয়া যাইতে পারে। ঈশ্বর যেমন সকলের ঈশ্বর তেমনি তিনি প্রত্যেকের ঈশ্বর, যেমন তিনি জ্ঞানের ঈশ্বর তেমনি তিনি হৃদয়ের ঈশ্বর, তিনি যেমন সমস্ত জগতের দেবতা তেমনি আমাদের গৃহদেবতা। তাঁহাকে রাজা বলিয়াও দেখিতে পারি, তাঁহাকে পিতা বলিয়াও দেখিতে পারি। কিন্তু পিতা ঈশ্বর আমাদের যত নিকটের, তিনি আমাদের হৃদয়ের যত অভাব মোচন করেন, এমন রাজা ঈশ্বর নহেন। তেমনি ব্রহ্ম ভারতবর্ষের গৃহদেবতা, তিনি ভারতবর্ষের পিতা। তিনি ভারতের হৃদয়ের যত নিকটবর্তী, তিনি ভারতের অভাব যত বুঝিবেন, এমন আর কেহ নহে। ব্রহ্মই ভারতবর্ষের জাগ্রত দেবতা; জিহোবা, গড্‌ অথবা আল্লা আমাদের ভাবের সম্পূর্ণ গম্য নহেন। রামমোহন রায় হৃদয়ের উদারতা-বশত ইহা বুঝিয়াছিলেন। সংকীর্ণ দৃষ্টি হইলে ভারতের এ মর্মান্তিক অভাব হয়তো তাঁহার চক্ষে পড়িত না। পিতামহ ঋষিরা যে ব্রহ্মকে বহু সাধনা-দ্বারা আবাহন করিয়া আমাদের ভারতবাসীর হৃদয়ের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত করিয়াছিলেন, আমাদের হীনতা-অন্ধকারে যে ব্রহ্মের মূর্তি এতদিন আচ্ছন্ন হইয়া আছে, রামমোহন রায় সেই ব্রহ্মকে আমাদের হৃদয়ে পুনঃ-প্রতিষ্ঠিত করিতে উদ্যত হইয়াছেন; আমরা যদি তাঁহার সেই শুভসংকল্প সিদ্ধ করি তবেই তাঁহার চিরস্থায়ী স্মরণস্তম্ভ পৃথিবীতে স্থাপন করিতে পারিব। আমরা অগ্রে ভারতবর্ষের মন্দিরে সনাতন ব্রহ্মের প্রতিষ্ঠা করিব; অবশেষে এমন হইবে যে পৃথিবীর চারি দিক হইতে ধর্মার্থীরা ভারতবর্ষের তীর্থক্ষেত্রে ব্রহ্মদর্শন-লালসায় দলে দলে আগমন করিতে থাকিবে। তখনই রাজা রামমোহন রায়ের জয়। তিনি যে সত্যের পতাকা ধরিয়া ভারতভূমিতে দাঁড়াইয়াছিলেন সেই পুরাতন সত্যের জয়। তখন সেই রামমোহন রায়ের জয়ে, ঋষিদের জয়ে, সত্যের জয়ে, ব্রহ্মের জয়ে আমাদের ভারতবর্ষেরই জয়।