গোড়ায় গলদ
চুপচাপ গম্ভীর হয়ে বসেছিলেন। কী কথা ভাবছিলেন কে জানে। সত্যি আমার জানতে ইচ্ছে করে। থেকে থেকে একটা খাতা খুলে দেখছিলেন। সেই খাতাটা ঐ ভুলে ফেলে গেছেন। ওটা আমাকে দেখতে হচ্ছে। (খাতা খুলিয়া) ও মা! এ যে কবিতা! কাদম্বিনীর প্রতি! আ মরণ! সে পোড়ারমুখী-আবার কে।

জল দিবে অথবা বজ্র, ওগো কাদম্বিনী,

হতভাগ্য চাতক তাই ভাবিছে দিনরজনী!

ইস! ভারি যে অবস্থা খারাপ দেখছি! এত বেশি ভাবনায় কাজ কী! আমি যদি পোড়াকপালী কাদম্বিনী হতুম তা হলে জলও দিতুম না বজ্রও দিতুম না, হতভাগ্য চাতকের মাথায় খানিকটা কবিরাজের তেল ঢেলে দিতুম। খেয়ে দেয়ে তো কাজ নেই—কোথাকার কাদম্বিনীর নামে কবিতা, তাও আবার দুটো লাইন ছন্দ মেলে নি। এর চেয়ে আমি ভালো লিখতে পারি।

আর কিছু দাও বা না দাও, অয়ি অবলে সরলে,

বাঁচি সেই হাসিভরা মুখ আর একবার দেখিলে।

আহা-হা-হা-হা! অবলে সরলে! কোন্‌ এক বেহায়া মেয়ে ওঁকে হাসিভরা কালামুখ দেখিয়ে দিয়েছিল, এক তিল লজ্জাও করে নি। বাস্তবিক, পুরুষগুলো ভারি বোকা। মনে করলে ওঁর প্রতি ভারি অনুগ্রহ করে সে হেসে গেল— হাসতে নাকি সিকি পয়সার খরচ হয়। দাঁতগুলো বোধ হয় একটু ভালো দেখতে ছিল তাই একটা ছুতো করে দেখিয়ে দিয়ে গেল। কই আমাদের কাছে তো কোনো কাদম্বিনী সাত পুরুষে এমন করে হাসতে আসে না। অবলে সরলে! সত্যি বাপু,মেয়ে জাতটাই ভালো নয়। এত ছলও জানে! ছি ছি! এ কবিতাও তেমনি হয়েছে। আমি যদি কাদম্বিনী হতুম তো এমন পুরুষের মুখ দেখতুম না। যে লোক চোদ্দটা অক্ষর সামলে চলতে পারে না, তার সঙ্গে আবার প্রণয়! এ খাতা আমি ছিঁড়ে ফেলব—পৃথিবীর একটা উপকার করব—কাদম্বিনীর দেমাক বাড়তে দেব না।

পুরুষের বেশে হরিলে পুরুষের মন,

(এবার) নারীবেশে কেড়ে নিয়ে যাও জীবন মরণ।

এর মানে কী!

কদম্ব যেমনি আমা প্রথম দেখিলে,

কেমন করে ভৃত্য বলে তখনি চিনিলে!

ও মা! ও মা! ও মা! এ যে আমারই কথা! এইবার বুঝেছি পোড়ারমুখী কাদম্বিনী কে! (হাস্য) তাই বলি, এমন করে কাকে লিখলেন! ও মা, কত কথাই বলেছেন! আর-একবার ভালো করে সমস্তটা পড়ি! কিন্তু কী চমৎকার হাতের অক্ষর! একেবারে যেন মুক্তো বসিয়ে গেছে।
[ নীরবে পাঠ
পশ্চাৎ হইতে খাতা অন্বেষণে নিমাইয়ের প্রবেশ

কিন্তু ছন্দ থাক্‌ না-থাক্‌ পড়তে তো কিছুই খারাপ হয় নি। সত্যি, ছন্দ নেই বলে আরো মনের সরল ভাবটা ঠিক যেন প্রকাশ হয়েছে। আমার তো বেশ লাগছে। আমার বোধ হয় ছেলেদের প্রথম ভাঙা কথা যেমন মিষ্টি লাগে, কবিদের প্রথম ভাঙা ছন্দ তেমনি মিষ্টি লাগে; পড়তে গেলে বুকের ভিতরটা কী একরকম করে ওঠে— বড়ো বড়ো কবিতা পড়ে এমন হয় না। মেঘনাদবধ, বৃত্রসংহার, পলাশির যুদ্ধ, সে-সব যেন ইস্কুলের বই—এমন সত্যিকার না। ( খাতা বুকে চাপিয়া)। এ খাতা আমি নিয়ে যাব—এ তো আমাকেই লিখেছেন। আমার এমনি আনন্দ হচ্ছে! ইচ্ছে করছে এখনি দিদিকে গিয়ে জড়িয়ে ধরি গে! আহা, দিদি যাকে বিয়ে করছে তাকে