নলিনী
চতুর্থ দৃশ্য
দেশ
নীরদ নীরজা

নীরদ। এই তো আবার সেই দেশে ফিরে এলুম। মনে করি নি আর কখনো ফিরব। তোমাকে যদি না পেতুম তবে আর দেশে ফিরতুম না।

নীরজা। এমন সুন্দর দেশ আমি কোথাও দেখি নি। এ যেন আমার সব স্বপ্নের মতো মনে হচ্চে। এত পাখী, এত শোভা আর কোথায় আছে।

নীরদ। (স্বগত) এই মমতার কিছু অংশও যদি তার থাকত! এত কাল যে আমি ছায়ার মত তার কাছে কাছে ছিলুম, আমাকে ভালো নাই বাসুক, একটুকু মায়াও কি আমার উপর জড়ায় নি, যে একখানি চিঠি লিখে আমাকে জিজ্ঞাসা ক’রে তুমি কেমন আছ? আজও সে তার বাগানে তেমনি ক’রে হেসে খেলে বেড়াচ্ছে? আমি চ’লে এসেছি বলে তার জগতের একটি তিলও শূন্য হয় নি? কেনই বা হবে? নিষ্ঠুর মমতাহীন জড়প্রকৃতির এই রকমই তো নিয়ম! আমি চ’লে এসেছি ব’লে কি তার বাগানে একটি বেল ফুলও কম ফুটবে? একটি পাখীও কম ক’রে গাবে? কিন্তু তাই বলে কি রমণীর প্রাণও সেই রকম?

নীরজা। নীরদ,তোমার মনের দুঃখ আমার কাছে প্রকাশ ক’রে কি তোমার একটু শান্তি হয় না। আমাকে কি তুমি ততটুকুও ভালোবাস না? তবে আজ কেন তুমি আমাকে কিছু বলচ না? কেন আপনার দুঃখ নিয়ে আপনি ব’সে আছ?

নীরদ। নীরজা, তুমি কি মনে করচ, আমি নলিনীকে ভালোবেসে কষ্ট পাচ্চি? তা মনেও করো না। তাকে আমি ভালোবাসব কি ক’রে? তাতে আমাতে যে আকাশ পাতাল প্রভেদ।

নীরজা। কিন্তু,কেনই বা তাকে না ভালোবাসবে? হয়ত সে ভালোবাসার যোগ্য।

নীরদ। না নীরজা, আমি তাকে ভালোবাসি নে। আমি তোমাকে বারবার ক’রে বলোচি,আমি তাকে ভালোবাসি নে। এক কালে ভালোবাসি বলে ভ্রম হয়েছিল। কিন্তু সে ভ্রম একেবারে গিয়েছে। কেনই বা আমি তাকে ভালো-বাসব? সে কি আমাকে মমতা করতে পারে? সে কি আমার প্রাণের কথা বুঝতে পারে? তার কি হৃদয় আছে? সে কেবলো হাসতেই জানে,সে কি পরের জন্যে কখনও কেঁদেছে?

নীরজা। কিন্তু সত্যি কথা বলি নীরদ,তোমরা পুরুষ মানুষেরা আমাদের ঠিক বুঝতে পার না। তুমি হয়ত জান না তার প্রাণের মধ্যে কি আছে! হয়ত সে তোমাকে ভালোবাসে।

নীরদ। তা হবে। হয়ত তার প্রাণের কথা আমি ঠিক জানি নে। কিন্তু এ প্রতারণায় তার আবশ্যক কি ছিল? যখন তার মুখে কেবলমাত্র একটি কথা শোনবার জন্য আমার সমস্ত প্রাণের আশা একেবারে উন্মুখ হয়েছিল, তখন সে কেন মুখ ফিরিয়ে অন্যমনস্কের মত ফুল কুড়োতে লাগল? আমার কথার কি একটি উত্তরও সে দিতে পারত না?

নীরজা। কেমন ক’রে দেবে বলো? ক্ষুদ্র বালিকা সে,সে কি ভাষা জানে যে তার প্রাণের সব কথা বলোতে পারে? সে হয়ত ভাবলে,আমার মনের কথা আমি কিছুই ভালো ক’রে বলতে পারব না, সেই জন্যেই তুমি যদি আমার কথা ঠিক না বুঝতে পার, যদি দৈবাৎ আমার একটি কথাও অবিশ্বাস কর, তা হলে সে কি যন্ত্রণা! কি লজ্জা!

নীরদ। কিন্তু আমি কি তার ভাবেও কিছু বুঝতে পারতুম না!