নলিনী
যাক। দেখ নীরজা, যদিও আমাদের বিবাহের দিন কাছে এসেচে, তবু মনে হচ্চে যেন এখনো কত দিন বাকী আছে! সময় যেন আর কাটচে না!

নীরজা। (নীরদের হাত ধরিয়া নিশ্বাস ফেলিয়া) নীরদ, আমার চোখে জল আসচে, কিছু মনে করো না। বিবাহের দিন ত কাছে আসচে, এই সময় একবার মনে করে দেখ আমরা কি করচি— কোথায় যাচ্চি। দেখো ভাই, আমাদের এ বাসরঘর শ্মশানের উপর গড়া নয়ত! তার চেয়ে এস,এইখান থেকেই আমাদের ছাড়াছাড়ি হোক। তুমি এক দিকে যাও,আমি এক দিকে যাই। আমাদের সমুখে সংশয়ের সমুদ্র, কি হ’তে পারে কে জানে! আমরা দুজনে মিলে এই সমুদ্রের উপকূল পর্য্যন্ত এসেছি, আর এক পা এগিয়ে কাজ নেই। এইখানেই এসো আমরা ফিরে যাই, যে যার দেশে চ’লে যাই। দুদিনের জন্যে দেখা হয়েছে, তোমাকে আমি ভালোবেসেছি – কিন্তু তাই ব’লে এই আঁধার সমুদ্রে আমার ভারে তোমাকে ডোবাই কেন?

নীরদ। এ কি অশুভ কথা নীরজা? এ কি অমঙ্গল! কেঁদ না নীরজা! তোমার অশ্রুজল আজকের শোভা পায় না নীরজা!
vনীরজা। কে জানে ভাই! আমার মনে আজ কেন এমন আশঙ্কা হচ্চে? আমার প্রাণের ভিতর থেকে যেন কেঁদে উঠচে! আমাকে মাপ কর। ঈশ্বর জানেন আমি নিজের জন্যে কিছুই ভাবছি নে; আমার মনে হচ্চে এ বিবাহে তুমি সুখী হ’তে পারবে না।

নীরদ। নীরজা, তবে তুমি আজ আমাকে এই অন্ধকারের মধ্যে পরিত্যাগ করতে চাও? তুমি ছাড়া আর কোথাও আমার আশ্রয় নেই – কেউ আমাকে মমতা ক’রে না, কেউ আমাকে তার হৃদয়ের মধ্যে একটুখানি স্থান দেয় না - কেউ আমার মনের ব্যথা শোনে না, আমার প্রাণের কথা বোঝে না, তুমি আমাকে ছেড়ে চ’লে যাবে? তা’হলে আমি কোথায় গিয়ে দাঁড়াব?

নীরজা। না না – অমি কি তোমাকে ছেড়ে যেতে পারি? যা হবার তা হবে, আমি তোমার সাথের সাথী রইলেম – ডুবি তো দুজনে মিলে ডুবব। যদি এমন দিন আসে তুমি আমাকে ভালোবাসতে না পার, তোমার সঙ্গে আমার যদি বিচ্ছেদ হয় তো –

নীরদ। ও কি কথা নীরজা? ও কথা মনেও আনতে নেই ! দুঃখ এসে যাদের মিলন ক’রে দেয়, চোখের জলের মুক্ত’র মালা যারা বদল করেছে, তাদের সে মিলন পবিত্র –- জন্মে জন্মে তাদের আর বিচ্ছেদ হয় না। হাসি খেলার চপলতার মধ্যে আমাদের মিলন হয় নি, আমাদের ভয় কিসের?

নীরজা। নীরদ, দেখি তোমার হাতখানি, তোমাকে একবার স্পর্শ ক’রে দেখি, ভালো ক’রে ধ’রে রাখি, কেউ যেন ছিঁড়ে না নেয়!

নীরদ। এই নাও আমার হাত। আজ থেকে তবে আর আমরা বিচ্ছিন্ন হব না? আজ থেকে তবে সুদীর্ঘ
জীবনের পথে আমরা দুজনে মিলে যাত্রা করলেম?

নীরজা। হাঁ প্রিয়তম!
vনীরদ। আজ থেকে তবে তুমি আমার বিষাদের সঙ্গিনী হ’লে,অশ্রুজলের সাথী হ’লে?

নীরজা। হাঁ প্রিয়তম!

নীরদ। আমার বিষাদের গোধূলির মধ্যে তুমি সন্ধের তারাটির মত ফুটে থাকবে। তোমাকে আমি কখনো হারাব না – চোখে চোখে রেখে দেব!