পরিশিষ্ট
আকাঙ্ক্ষাকে কিছু উদ্দীপিত করিতে পারি। আমার মানসিক গঠনে আবশ্যক পরিমাণ দম্ভ নাই বলিয়া এ ব্যাপারটি আমার মনে চিরকাল বিস্ময় হইয়া আছে।

তার পর আমাদের সময় কাটিয়াছে দ্রুত, আমাদের আশা পূর্ণতা লাভ করিয়াছে। তাঁহার দ্রুতবর্ধমান সাফল্যের কালে তাঁহার লক্ষ্যপথে আমার সঙ্গদানের প্রেরণা আমি ক্রমশ কম বোধ করিয়াছি। তাঁহার পথ তখন আর দুর্গম বা অনিশ্চয় ছিল না। তাঁহার কর্মজীবনের মেঘাবৃত প্রভাতে ভাগ্যের দ্বিধাবিজড়িত বেদনাকর মুহূর্তে আমার অবিচলিত বিশ্বাস দ্বারা তাঁহার আত্মবিশ্বাসকে কিছু দৃঢ়তর করার গৌরব আমি দাবি করিতে পারি, আমার দাবি অসংগত নয়। সন্ধিক্ষণে সেইরূপ সামান্য সংগতির লোকও খুব বেশি কাজে আসে।

জয়ের উপর যথার্থ শক্তির দাবি অপ্রতিযোগ্য। তাহার ভ্রমণপথে সমস্ত সমধর্মী উপাদানকে আকর্ষণ করিয়া সে কাজে লাগায় এবং জয়শ্রীর প্রতিমূর্তি গড়িয়া তোলে। এই বিজ্ঞান মন্দির সেইরূপ একটি প্রতিমূর্তি, ইহার মধ্যে আচার্যের জীবনব্যাপী উদ্যম, অনুরূপ উদ্যমের প্রেরণা কেন্দ্ররূপে স্থায়ী মূর্তি গ্রহণ করিয়াছে।

ভাগ্যের প্রতি আচার্যের প্রতিভা প্রথম যে দ্বন্দের আহ্বান জানায়, তাহার সহিত আমার সংযোগ দূর ইতিহাসের কথা; আমার নিজের কাছেই সে পৃষ্ঠা অস্পষ্ট হইয়া আসিয়াছে। এই কারণে এই প্রতিষ্ঠানের আনুষ্ঠানিক সভায় সম্মান-আসনে উপবেশনের আমন্ত্রণ গ্রহণে আমি রীতিমতো ইতস্তত করিয়াছিলাম। যৌবনের প্রগল্‌ভতার মূঢ় গর্বে আমি কল্পনা করিয়াছিলাম যে, আমার সম্মুখে যে ইতিহাস রূপ গ্রহণ করিতেছে, আমার সাহচর্যও তাহার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গরূপে গড়িয়া উঠিতেছে। সেই বিশ্বাসে আমি আচার্যকে উৎসাহদানের চেষ্টা করি; সে চেষ্টা ছিল আমার অহমিকারই অঙ্গ। কিন্তু মূঢ় যৌবন চিরজীবী নয়; আমার ক্ষমতার সীমা উপলব্ধি করিবার সময় আমি পাই। এ কথা সকলেরই জানা, আমি নেহাত একজন কবি; ভাষা মন্দিরে আমার সাধনা, এ দেবতা সবচেয়ে খেয়ালি, যুক্তির নিকট তাঁহার দায়িত্ব তিনি প্রায়ই ভুলিয়া যান এবং প্রায়ই কল্পনার ছায়াচ্ছন্ন জগতে নিজেকে হারাইয়া ফেলেন। পবিত্র পীঠস্থানে যোগ্য অর্ঘ্যদান আমাদের প্রাচ্য রীতি; কিন্তু বিদ্বান সমাজের এই স্মরণীয় সম্মেলনে আমার ভাষার অর্ঘ্য নিতান্ত অনুপযুক্ত।

সৌভাগ্যক্রমে আমাদের মধ্যে আজ এমন কয়েকজন আছেন, যাঁহারা বিজ্ঞানের রাজ্যে অভিজাত শ্রেণীর সহিত সমান আসনের অধিকারী এবং যাঁহাদের চিন্তাসম্ভার এই অনুষ্ঠানকে সমৃদ্ধ করিবে বলিয়া আশা করা যায়। আমি শুধু এই প্রতিষ্ঠানকে আশীর্বাদ করিতে পারি দূর হইতে, যেখানে এই দেশের অবজ্ঞাত জনগন পুরুষ-পরম্পরায় আদিম হলকর্ষণের নিষ্করুণ শ্রমকে অসহায়ভাবে স্বীকার করিয়া লইয়াছে। বৈজ্ঞানিক শয়তানীর বিপদ এবং জীবনের সম্পদ শোষণ হইতে যে জ্ঞান তাহাদের রক্ষা করিতে পারে সেই জ্ঞান হইতে তাহারা বঞ্চিত; এই-সব বিড়ম্বিত হতভাগ্যের নিকটে বসিয়া আমি বিজ্ঞান মন্দিরের যশস্বী প্রতিষ্ঠাতার উদ্দেশে আমার শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করিতেছি। যে দস্যুরা বিজ্ঞানের মহৎ ব্রতকে অকুণ্ঠ বর্বরতায় পর্যবসিত করিতেছে, তাহাদের কবল হইতে পৃথিবীকে উদ্ধার করিবার জন্য আমরা যেন স্বয়ং বিজ্ঞানের নিকট আমাদের আহ্বান জানাই, বিজ্ঞান মন্দিরের প্রতি আমার এই আবেদন।