পরিশিষ্ট
জগদীশচন্দ্র বসু
স্যার জগদীশের ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে আসার সৌভাগ্য যখন আমার হয় তখন তিনি যুবক এবং আমিও ছিলাম তাঁহার প্রায় সমবয়সী। সে সময় জড়জগতের সহিত প্রাণীজগতের গভীর আত্মীয়তার কল্পনায় তিনি আচ্ছন্ন মূক প্রকৃতির গোপন ভাষা জানিবার জন্য তাঁহার আশ্চর্য আবিষ্কার-প্রতিভার নিয়োজনে ব্যাপৃত। বাহিরের পরস্পর বিরোধিতার অন্তরালের যে জগতের অর্থ লুকানো, তাহার রহস্য ধরা পড়িতেছে তাঁহার নিপুণ জিজ্ঞাসার সাড়ায়। তাঁহার নিরন্তর বিস্ময়ের দৈনন্দিন আনন্দের অংশভাগী হওয়ার বিরল সৌভাগ্য আমার হইয়াছিল। আদিম যুগে সমস্ত বস্তুর শৈশব সারল্যে একটা সাধারণ যোগসূত্র ধরা পড়িত; আমার বিশ্বাস, কবির মন সেই আদিম কালের উত্তরাধিকারী। সমস্ত সৃষ্টির উপর নিজের সত্তা বিস্তৃত রহিয়াছে, এই অনুভূতির আনন্দ আস্বাদন করেন মায়ার এই পূজারীরা; তাই আপাতদৃষ্টিতে যাহা প্রাণহীন তাহার মধ্যে প্রাণীয় সমধর্ম তাঁহারা খোঁজেন। মনের এই ভঙ্গি সব ক্ষেত্রেই কোনো নির্দিষ্ট বিশ্বাসের— সর্বজীবত্ববাদই হোক বা সর্বেশ্বরবাদই হোক— উপর প্রতিষ্ঠিত নয়। এ ভঙ্গি নিছক মন ভুলানো হইতে পারে, যেমন দেখি শিশুর খেলায়; নৈসর্গিক জগতের সমস্ত ক্রিয়ায় প্রাণশক্তি আরোপের যে ঝোঁক আমাদের অবচেতন মনের আছে সেই ঝোঁক হইতেই শিশুর খেলার সৃষ্টি। শৈশব হইতেই আমি উপনিষদের পরিচয় লাভ করি; আদিম অপরোক্ষানুভূতিতে উপনিষদ ঘোষণা করে যে, এই পৃথিবীতে যাহা-কিছু বিদ্যমান সমস্তই প্রাণশক্তিতে স্পন্দমান, যে প্রাণ অনন্তে একীভূত।

এ কারণেই আমি উদ্‌গ্রীব উৎসাহে আশা করিতে থাকি, পৃথিবীতে প্রাণের সীমাহীন বিস্তৃতির কল্পনা এইবার বিজ্ঞানের কষ্টিপাথরে মঞ্জুর হইবে। নিভৃত সাধনপথে আচার্যের পদাঙ্ক অনুসরণের সুযোগ আমি পাই; আমি ছিলাম পল্লবগ্রাহী, তবু প্রাত্যহিক বিষয়ের সমারোহে আমার ভাগ ছিল তাহার দুর্গম যাত্রার এই প্রারম্ভকালে যখন বাধা ছিল প্রচুর ও দুর্লঙ্ঘ্য এবং গুনগ্রাহীতার উপর ছিল ঈর্ষার পাষাণভার, তখন তাঁহার পক্ষে সুহৃদ সঙ্গ ও সহানুভূতির কিছু মূল্য ছিল— আসুক না সে সঙ্গ ও সহানুভূতি এমন একজনের নিকট হইতে, যে তাঁহার সহিত মানসিক যোগাযোগ রক্ষার পূর্ণ যোগ্যতার অধিকারী। তবু আমার সগর্ব দাবি এই যে, সেই স্বল্প স্বীকৃতি ও জনসাধারণের দুর্বল সমর্থনের কালে আমি তাঁহাকে তাঁহার কোনো কোনো আশু প্রয়োজনে ও মাঝে মাঝে হতাশার মুহূর্তে সাহায্য করিয়াছি।

আমার সেই দূরাপসৃত স্মৃতির পটভূমিতে তাঁহার বিপুল ভবিষ্যৎ সাফল্যের স্বল্পতম আলোকরেখা দেখিতে পাই না। দেশবাসীকে বিজ্ঞানের কল্যাণস্পর্শে সঞ্জীবিত করিবার জন্য সমৃদ্ধ এই বিজ্ঞান মন্দির নির্মাণের পক্ষে আবশ্যক প্রভূত সম্পদের সহিত বৈজ্ঞানিক খ্যাতিকে যুক্ত করিয়াছিল যে সাফল্য, তাহার কোনো চিহ্নই সে পটভূমিতে দেখি না। বাস্তবিক, আমার কতকগুলি পুরানো চিঠি আজ পড়িলে আমার নিজের প্রতি করুণা হয়, আমার হাসি পায়। আমার প্রতি বিশ্বাস রাখার মূর্খতা যাহাদের ছিল সেই বন্ধুদের উৎসাহ জিয়াইয়া রাখিবার মতো পুঁজি আমার খুব কম ছিল; তবু সেই সময় তাঁহার অর্থ ভাণ্ডারের ঘাটতি পূরণ করিবার সম্ভাবনার কথা জানাইয়া তাঁহাকে উৎসাহ দিবার চেষ্টা করিয়াছি। পরে তিনি নিজের আশ্চর্য ব্যক্তিত্ব দ্বারা এবং তাঁহার প্রতিভার প্রতি জনসাধারণের বিশ্বাস জাগ্রত করিয়া শ্রদ্ধার অজস্র দানলাভ করেন; তাঁহার পাশে আমার অনিয়মিত সাহায্য তুচ্ছ ও হাস্যকর; আমার সেই-সব প্রতিশ্রুতির গর্বিত গাম্ভীর্যের কথা ভাবিলেও হাসিও পায়, ভালোও লাগে। কিন্তু আমি আবার বলি, অবাস্তব স্বপ্ন দেখায় মাধুর্য ছিল; মাধুর্য ছিল যথাসাধ্য সাহায্য দান, যতই সে সামান্য হোক। কারিণ মহত্ত্বের প্রতি বিশ্বাসের যে আনন্দ ও যে সাহস আছে তাহার প্রমাণ উহাতে পাই আর মহত্ত্বে বিশ্বাসই তো মনের মহার্ঘ সম্পদ।

বিজ্ঞানীর আত্মোপলব্ধির উজ্জ্বল মুহূর্তে খেয়ালি কবি তাঁহার যোগ্য সঙ্গী নয়; তা ছাড়া আমার শিক্ষাতেও ছিল ত্রুটি তথাপি আমি তাঁহার অন্তরঙ্গ বন্ধুরূপে গৃহীত হই এবং সম্ভবত আমাদের স্বভাবগত বৃত্তির বৈপরীত্যের জন্যই আমি তাঁহার সিদ্ধির