‘প্রাচীন-কাব্য সংগ্রহ’

ইহাতে কৃষ্ণের শরীরের বর্ণনা হইতেছে। ‘নখ চন্দ্রমালা শোভিত-পদকমলদ্বয়ের উপরে তরুণ তমালবৎ কৃষ্ণের শরীর উঠিয়াছে। পীতাম্বর বিদ্যুতে তাঁহাকে বেড়িয়াছে। সে তমাল তরুর শাখাশিখর, অর্থাৎ মুখ, সুধাকর। লাবণ্যই বোধ করি অরুণ ভাতির পল্লব। ওষ্ঠাধর বিম্বফলদ্বয়। তাহার উপর কিরণ অর্থাৎ হাস্য স্থির বাস করে। নেত্র খঞ্জন। কুন্তল, সাপিনী।’

অন্ধকার রাত্রে রাধিকা অভিসার উদ্দেশে বাহির হইয়াছেন, কৃষ্ণ বিঘ্ন আশঙ্কা করিতেছেন।

গগন সঘন, মহী পঙ্কা;

বিঘিনি বিথারিত উপজয়ে শঙ্কা

দশদিশ ঘন আন্ধিয়ারা;

চলইতে খলই, লখই নাহি পারা।

সব যোনি পালটি ভুললি

আওত মানবি ভানত লোলি। সং ৩৪, পৃ. ৩৪

সম্পাদক শেষ দুই চরণের অর্থ নিম্নলিখিতরূপে করিতেছেন। ‘শ্রীকৃষ্ণ রাধিকার অনুপস্থিতিতেও তাঁহাকে সম্বোধন করিয়া বলিতেছেন ‘লোলে, (লোলি) তুমি যদি (নিরাপদে) উপস্থিত হও (আওত) তাহা হইলে আমি মনে মনে করিব (মানবি) যে, সকল জীবকে (যোনি) দৃষ্টিপাত দ্বারা (পালটি) তোমার প্রভায় নত করিয়া (ভানত) ভুলাইয়াছে (ভুললি)।’ এইরূপ অর্থ কষ্টসাধ্য সন্দেহ নাই, কিন্তু আমরা অন্য কোনো সুলভ অর্থ বা পাঠ সংগ্রহ করিতে পারিলাম না।’ সম্পাদক স্বীকার করিয়াছেন উপরি-উদ্‌ধৃত অর্থটি কষ্টসাধ্য। আমরা কহিতেছি, উহা ব্যাকরণ-সংগতও নহে। ‘ভুললি’ অর্থে ‘ভুলাইয়াছ’ হয় না, উহার অর্থ ভুলিলি, অথবা স্ত্রীলিঙ্গ কর্তার সহিত যুক্ত হইলে, ভুলিল। ‘মানবি’ শব্দের অর্থ ‘মনে করিব’ নহে, ‘মনে করিবি’ হইতে পারে; বিশেষত উহার কর্তা স্ত্রীলিঙ্গ নহে। আমরা উপরি-উক্ত দুই চরণের এইরূপ অর্থ করি : ‘আওত মানবী, ভানত লোলি। ভানত অর্থাৎ ভাবের দ্বারা লোলা, চঞ্চল মানবী আসিতেছেন। সব যোনি পালটি ভুললি। সকল প্রাণীকে দেখিতে ভুলিলেন। এত অধীরা যে, কাহারো প্রতি দৃষ্টিপাত করিতে পারিতেছেন না।’

রাধিকা শ্যামকে ভর্ৎসনা করিয়া দূতী পাঠাইতেছেন। দূতীকে কহিতেছেন:

যো পুন সহচরি, হোয় মতিমান্‌।

করয়ে পিশুন-বচন অবধান॥ সং ৭০, পৃ. ৬২

সম্পাদক টীকা করিতেছেন ‘কাকের কথাতেই মনঃসংযোগ করেন!’ এ টীকার টীকা কে করিবে? অনেক অনেক মতিমান্‌ দেখিয়াছি, তাঁহারা কাকের কথায় কিছুমাত্র মনোযোগ দেন না। টীকাকার মহাশয় নিজে কী করেন? যাহা হউক, এমন মতিমান্‌ যদি কেহ থাকেন যিনি কেবলমাত্র কাকের কথাতেই মনঃসংযোগ না করেন, এক-আধবার আমাদের কথাও তাঁহার কানে পৌঁছায়, তবে তিনি অনুগ্রহ করিয়া এ রহস্য কি আমাদের বুঝাইয়া দিবেন? বলা বাহুল্য, ইহার অর্থ—‘যাঁহারা মতিমান্‌ তাঁহারা পিশুন-বচন অর্থাৎ নিন্দাবাক্যও অবধান করেন।’

রাধিকা অভিমানভরে কহিতেছেন;

‘কুজনক পীরিতি মরণ-অধীন।’ সং ৮৫, পৃ. ৩৪

এই অতি সহজ চরণটির টীকায় সম্পাদক কহেন—‘কুজনের সহিত প্রীতি করিয়া এক্ষণে মরণের বশতাপন্ন হইলাম অথবা কুজনের প্রেম মরণাপেক্ষাও মন্দ।’ এত কথা সম্পাদক কোথায় পাইলেন? ইহার অতি সহজ অর্থঃ

‘কুজনের প্রীতি মরণের অধীন, অর্থাৎ অধিক দিন বাঁচে না।’