অত্যুক্তি
বর্ণে চিত্রে নানা অক্ষরে দেশে বিদেশে নিজেকে কিরূপ ঘোষণা করে তাহা আমরা জানি–এবং আজকাল আমরাও ভদ্রাভদ্রে মিলিয়া নির্লজ্জভাবে এই অভ্যাস গ্রহণ করিয়াছি। বিলাতে পলিটিক্‌সে বানানো বাজেট তৈরি করা, প্রশ্নের বানানো উত্তর দেওয়া প্রভৃতি অভিযোগ তুলিয়া এক পক্ষের প্রতি অপর পক্ষে যে-সকল দোষারোপ করিয়া থাকেন তাহা যদি মিথ্যা হয় তবে লজ্জার বিষয়, যদি না হয় তবে শঙ্কার বিষয় সন্দেহ নাই। সেখানকার পার্লামেণ্টে পার্লামেণ্ট্‌-সংগত ভাষায় এবং কখনো বা তাহা লঙ্ঘন করিয়াও বড়ো বড়ো লোককে মিথ্যুক, প্রবঞ্চক, সত্যগোপনকারী বলা হইয়া থাকে। হয় এরূপ নিন্দাবাদকে অত্যুক্তিপরায়ণতা বলিতে হয়, নয় ইংলণ্ডের পলিটিক্‌স্‌ মিথ্যার দ্বারা জীর্ণ এ কথা স্বীকার করিতে হয়।

যাহা হউক, এ-সমস্ত আলোচনা করিলে এই কথা মনে উদয় হয় যে, বরঞ্চ অত্যুক্তিকে সুস্পষ্ট অত্যুক্তিরূপে পোষণ করাও ভালো, কিন্তু অত্যুক্তিকে সুকৌশলে ছাঁটিয়া-ছুঁটিয়া তাহাকে বাস্তবের দলে চালাইবার চেষ্টা করা ভালো নহে–তাহাতে বিপদ অনেক বেশি।

পূর্বেই বলিয়াছি, যেখানে দুইপক্ষে উভয়ের ভাষা বোঝে সেখানে পরস্পরের যোগে অত্যুক্তি আপনি সংশোধিত হইয়া আসে। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে বিলাতি অত্যুক্তি বোঝা আমাদের পক্ষে শক্ত। এইজন্য তাহা অক্ষরে অক্ষরে বিশ্বাস করিয়া আমরা নিজের অবস্থাকে হাস্যকর ও শোচনীয় করিয়া তুলিয়াছি। ইংরেজ বলিয়াছিল,’আমরা তোমাদের ভালো করিবার জন্যই তোমাদের দেশ শাসন করিতেছি, এখানে সাদা-কালোয় অধিকারভেদ নাই, এখানে বাঘে গোরুতে এক ঘাটে জল খায়, সম্রাট্‌শ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ আকবর যাহা কল্পনা মাত্র করিয়াছিলেন আমাদের সাম্রাজ্যে তাহাই সত্যে ফলিতেছে।’আমরা তাড়াতাড়ি ইহাই বিশ্বাস করিয়া আশ্বাসে স্ফীত হইয়া বসিয়া আছি। আমাদের দাবির আর অন্ত নাই। ইংরেজ বিরক্ত হইয়া আজকাল এই সকল অত্যুক্তিকে খর্ব করিয়া লইতেছে। এখন বলিতেছে,’যাহা তরবারি দিয়া জয় করিয়াছি তাহা তরবারি দিয়া রক্ষা করিব।’সাদা-কালোয় যে যথেষ্ট ভেদ আছে তাহা এখন অনেক সময়ে নিতান্ত গায়ে পড়িয়া নিতান্ত স্পষ্ট করিয়া দেখানো হইতেছে। কিন্তু তবু বিলাতি অত্যুক্তি এমনি সুনিপুণ ব্যাপার যে, আজও আমরা দাবি ছাড়ি নাই, আজও আমরা বিশ্বাস আঁকড়িয়া বসিয়া আছি, সেই-সকল অত্যুক্তিকেই আমাদের প্রধান দলিল করিয়া আমাদের জীর্ণচীরপ্রান্তে বহু যত্নে বাঁধিয়া রাখিয়াছি। অথচ আমরা প্রত্যক্ষ দেখিতেছি, এক সময়ে ভারতবর্ষ পৃথিবীকে কাপড় জোগাইয়াছে, আজ সে পরের কাপড় পরিয়া লজ্জা বাড়াইতেছে–এক সময়ে ভারতভূমি অন্নপূর্ণা ছিল, আজ’হ্যাদে লক্ষ্মী হইল লক্ষ্মীছাড়া’–এক সময়ে ভারতে পৌরুষরক্ষা করিবার অস্ত্র ছিল, আজ কেবল কেরানিগিরির কলম কাটিবার ছুরিটুকু আছে। ইস্ট্‌ ইণ্ডিয়া কোম্পানি রাজত্ব পাইয়া অবধি ইচ্ছাপূর্বক চেষ্টাপূর্বক ছলে বলে কৌশলে ভারতের শিল্পকে পঙ্গু করিয়া সমস্ত দেশকে কৃষিকার্যে দীক্ষিত করিয়াছে, আজ আবার সেই কৃষকের খাজনা বাড়িতে বাড়িতে সেই হতভাগ্য ঋণসমুদ্রের মধ্যে চিরদিনের মতো নিমগ্ন হইয়াছে–এই তো গেল বাণিজ্য এবং কৃষি। তাহার পর বীর্য এবং অস্ত্র, সে কথার উল্লেখ করিবার প্রয়োজন নাই। ইংরেজ বলে,’তোমরা কেবলই চাকরির দিকে ঝুঁকিয়াছ, ব্যাবসা কর না কেন?’এ দিকে দেশ হইতে বর্ষে বর্ষে প্রায় পাঁচ শত কোটি টাকা খাজনায় ও মহাজনের লাভে বিদেশে চলিয়া যাইতেছে। মূলধন থাকে কোথায়? এ অবস্থায় দাঁড়াইয়াছি। তবু কি বিলাতি অত্যুক্তির উপর সম্পূর্ণ নির্ভর করিয়া কেবলই দরখাস্ত জারি করিতে হইবে? হায়, ভিক্ষুকের অনন্ত ধৈর্য! হায়, দরিদ্রাণাং মনোরথাঃ! রোমের শাসনে, স্পেনের শাসনে, মোগলের শাসনে এতবড়ো একটা বৃহৎ দেশ কি এমন নিঃশেষে উপায়বিহীন হইয়াছে। অথচ পরদেশশাসন সম্বন্ধে এত বড়ো বড়ো নীতিকথার দম্ভপূর্ণ অত্যুক্তি আর কেহ কি কখনো উচ্চারণ করিয়াছে? কিন্তু এ-সকল অপ্রিয় কথা উত্থাপন করা কেন! কোনো একটা জাতিকে অনাবশ্যক আক্রমণ করিয়া পীড়া দেওয়া আমাদের দেশের লোকের স্বভাবসংগত নহে, ইহা আমরা ক্রমাগত ঘা খাইয়া ইংরেজের কাছ হইতেই শিখিয়াছি। নিতান্ত গায়ের জ্বালায় আমাদিগকে যে অশিষ্টতায় দীক্ষিত করিয়াছে তাহা আমাদের দেশের জিনিস নহে।