অত্যুক্তি
খেতাবের রাজকীয় নিলামের দোকান জমিয়া উঠে। আকবর শাজাহান প্রভৃতি বাদশারা নিজেদের কীর্তি নিজেরা রাখিয়া গেছেন, এখনকার দিনে রাজকর্মচারীরা নানা ছলে নানা কৌশলে প্রজাদের কাছ হইতে বড়ো বড়ো কীর্তিস্তম্ভ আদায় করিয়া লন। এই-যে সম্রাটের প্রতিনিধি সূর্যবংশীয় ক্ষত্রিয় রাজাদিগকে সেলাম দিবার জন্য ডাকিয়াছেন, ইনি নিজের দানের দ্বারায় কোথায় দিঘি খনন করাইয়াছেন, কোথায় পানথশালা নির্মাণ করিয়াছেন, কোথায় দেশের বিদ্যাশিক্ষা ও শিল্পচর্চাকে আশ্রয় দান করিয়াছেন। সেকালে বাদশারা, নবাবরা, রাজ-কর্মচারিগণও, এই-সকল মঙ্গলকার্যের দ্বারা প্রজাদের হৃদয়ের সঙ্গে যোগ রাখিতেন। এখন কর্মচারীর অভাব নাই, তাঁহাদের বেতনও যথেষ্ট মোটা বলিয়া জগদ্‌বিখ্যাত, কিন্তু দানে ও সৎকর্মে এ দেশে তাঁহাদের অস্তিত্বের কোনো চিহ্ন তাঁহারা রাখিয়া যান না। বিলাতি দোকান হইতে তাঁহারা জিনিসপত্র কেনেন, বিলাতি সঙ্গীদের সঙ্গে আমোদ-আহ্লাদ করেন, এবং বিলাতের কোণে বসিয়া অন্তিমকাল পর্যন্ত তাঁহাদের পেনশন সম্ভোগ করিয়া থাকেন।

ভারতবর্ষে লেডি ডফারিনের নামে যে-সকল হাঁসপাতাল খোলা হইল তাহার টাকা ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় ভারতবর্ষের প্রজারাই জোগাইয়াছে। এ প্রথা খুব ভালো হইতে পারে, কিন্তু ইহা ভারতবর্ষের প্রথা নহে, সুতরাং এই প্রকারের পূর্তকার্যে আমাদের হৃদয় স্পর্শ করে না। না করুক, তথাপি বিলাতের রাজা বিলাতের প্রথামতই চলিবেন, ইহাতে বলিবার কথা কিছু নাই। কিন্তু কখনো দিশি কখনো বিলিতি হইলে কোনোটাই মাননসই হয় না। বিশেষত, আড়ম্বরের বেলায় দিশি দস্তুর এবং খরচপত্রের বেলায় বিলিতি দস্তুর হইলে আমাদের কাছে ভারি অসংগত ঠেকে। আমাদের বিদেশী কর্তারা ঠিক করিয়া বসিয়া আছেন যে প্রাচ্য হৃদয় আড়ম্বরেই ভোলে, এইজন্যই ত্রিশ কোটি অপদার্থকে অভিভূত করিতে দিল্লির দরবার-নামক একটা সুবিপুল অত্যুক্তি বহু চিন্তায়-চেষ্টায় ও হিসাবের বহুতর কষাকষি-দ্বারা খাড়া করিয়া তুলিয়াছেন–জানেন না যে, প্রাচ্য হৃদয় দানে, দয়া-দাক্ষিণ্যে, অবারিত মঙ্গল-অনুষ্ঠানেই ভোলে। আমাদের যে উৎসবসমারোহ তাহা আহুত অনাহুত রবাহুতের আনন্দসমাগম, তাহাতে’এহি এহি দেহি দেহি পীয়তাং ভুজ্যতাং’রবের কোথাও বিরাম ও বাধা নাই। তাহা প্রাচ্য আতিশয্যের লক্ষণ হইতে পারে, কিন্তু তাহা খাঁটি, তাহা স্বাভাবিক। আর পুলিসের দ্বার সীমানাবদ্ধ, সঙিনের দ্বারা কন্টকিত, সংশয়ের দ্বারা সন্ত্রস্ত সতর্ক কৃপণতার দ্বারা সংকীর্ণ, দয়াহীন দানহীন যে দরবার, যাহা কেবলমাত্র দম্ভপ্রচার, তাহা পাশ্চাত্য অত্যুক্তি–তাহাতে আমাদের হৃদয় পীড়িত ও লাঞ্ছিত হয়-আমাদের কল্পনা আকৃষ্ট না হইয়া প্রতিহত হইতে থাকে। তাহা ঔদার্য হইতে উৎসারিত নহে, তাহা প্রাচুর্য হইতে উদ্‌বেলিত হয় নাই।

এই গেল নকল-করা অত্যুক্তি। কিন্তু নকল, বাহ্য আড়ম্বরে মূলকে ছাড়াইবার চেষ্টা করে এ কথা সকলেই জানে। সুতরাং সাহেব যদি সাহেবি ছাড়িয়া নবাবি ধরে তবে তাহাতে যে আতিশয্য প্রকাশ হইয়া পড়ে তাহা কতকটা কৃত্রিম, অতএব তাহার দ্বারা জাতিগত অত্যুক্তির প্রকৃতি ঠিক ধরা যায় না। ঠিক খাঁটি বিলাতি অত্যুক্তির একটা দৃষ্টান্ত মনে পড়িতেছে। গবর্মেন্ট্‌ সেই দৃষ্টান্তটি আমাদের চোখের সামনে পাথরের স্তম্ভ দিয়া স্থায়িভাবে খাড়া করিয়া তুলিয়াছেন, তাই সেটা হঠাৎ মনে পড়িল। তাহা অন্ধকূপহত্যার অত্যুক্তি।

পূর্বেই বলিয়াছি, প্রাচ্য অত্যুক্তি মানসিক ঢিলামি। আমরা কিছু প্রাচুর্যপ্রিয়, আঁটাআঁটি আমাদের সহে না। দেখো-না, আমাদের কাপড়গুলা ঢিলাঢালা, আবশ্যকের চেয়ে অনেক বেশি; ইংরেজের বেশভূষা কাটাছাঁটা, ঠিক মাপসই–এমন-কি, আমাদের মতে তাহা আঁটিতে আঁটিতে কাটিতে কাটিতে শালীনতার সীমা ছাড়াইয়া গেছে। আমরা-হয় প্রচুররূপে নগ্ন নয় প্রচুররূপে আবৃত। আমাদের কথাবার্তাও সেই ধরনের–হয় একেবারে মৌনের কাছাকাছি নয় উদারভাবে সুবিস্তৃত। আমাদের ব্যবহারও তাই, হয় অতিশয় সংযত নয় হৃদয়াবেগে উচ্ছ্বসিত।

কিন্তু ইংরেজের অত্যুক্তির সেই স্বাভাবিক প্রাচুর্য নাই; তাহা অত্যুক্তি হইলেও খর্বকায়। তাহা আপনার অমূলকতাকে নিপুণভাবে মাটি চাপা দিয়া ঠিক সমূলকতার মতো সাজাইয়া তুলিতে পারে। প্রাচ্য অত্যুক্তির’অতি’টুকুই শোভা, তাহাই তাহার