অত্যুক্তি
বসেন তখন কলোনিগুলির সামান্য শাসন-কর্তারা মাথার মুকুটে ঝল্‌মল্‌ করেন, আর ভারতবর্ষের প্রাচীনবংশীয় রাজগণ তাঁহার চরণ-নূপুরে কিংকিণীর মতো আবদ্ধ হইয়া কেবল ঝংকার দিবার কাজ করিতে থাকেন–এবারকার বিলাতি দরবারে তাহা বিশ্বজগতের কাছে জারি হইয়াছে। হায় জয়পুর! যোধপুর! কোলাপুর! ইংরেজ-সাম্রাজ্যের মধ্যে তোমাদের কোথায় স্থান তাহা কি এমন করিয়া দেশে বিদেশে ঘোষণা করিয়া আসিবার জন্যই এত লক্ষ লক্ষ টাকা বিলাতের জলে জলাঞ্জলি দিয়া আসিলে? ইংরেজের সাম্রাজ্য-জগন্নাথজির মন্দিরে যেখানে কানাডা নিউজিল্যাণ্ড্‌ অস্ট্রেলিয়া দক্ষিণ-আফ্রিকা স্ফীত উদর ও পরিপুষ্ট দেহ লইয়া দিব্য হাঁকডাক-সহকারে পাণ্ডাগিরি করিয়া বেড়াইতেছে সেখানে কৃশজীর্ণতনু ভারতবর্ষের কোথাও প্রবেশাধিকার নাই–ঠাকুরের ভোগও তাহার কপালে অল্পই জোটে–কিন্তু যেদিন বিশ্বজগতের রাজপথে ঠাকুরের অভ্রভেদী রথ বাহির হয় সেই একটা দিন রথের দড়া ধরিয়া টানিবার জন্য ভারতবর্ষের ডাক পড়ে। সেদিন কত বাহবা, কত করতালি, কত সৌহার্দ্য–সেদিন কার্জনের নিষেধশৃঙ্খলমুক্ত ভারতবর্ষীয় রাজাদের মণিমাণিক্য লণ্ডনের রাজপথে ঝল্‌মল্‌ করিতে থাকে এবং লণ্ডনের হাঁসপাতালগুলির’পরে রাজভক্ত রাজাদের মূষলধারে বদান্যতাবৃষ্টির বার্তা ভারতবর্ষ নতশিরে নীরবে শ্রবণ করে। এই ব্যাপারের সমস্তটা পাশ্চাত্য অত্যুক্তি। ইহা মেকি অত্যুক্তি, খাঁটি নহে।

প্রাচ্যদিগের অত্যুক্তি ও আতিশয্য অনেক সময়েই তাহাদের স্বভাবের ঔদার্য হইতেই ঘটিয়া থাকে। পাশ্চাত্য অত্যুক্তি সাজানো জিনিস, তাহা জাল বলিলেই হয়। দিল-দরাজ মোগল-সম্রাটের আমলে দিল্লিতে দরবার জমিত। আজ সে দিল নাই, সে দিল্লি নাই, তবু একটা নকল দরবার করিতে হইবে। সংবৎসর ধরিয়া রাজারা পোলিটিকাল্‌ এজেন্টের রাহুগ্রাসে কবলিত; সাম্রাজ্য-চালনায় তাহাদের স্থান নাই, কাজ নাই, তাহাদের স্বাধীনতা নাই–হঠাৎ একদিন ইংরেজ সম্রাটের নায়েব পরিত্যক্ত মহিমা দিল্লিতে সেলাম কুড়াইবার জন্য রাজাদিগকে তলব দিলেন, নিজের ভূলুন্ঠিত পোশাকের প্রান্ত শিখ ও রাজপুত রাজকুমারদের দ্বারা বহন করাইয়া লইলেন, আকস্মিক উপদ্রবের মতো একদিন একটা সমারোহের আগ্নেয় উচ্ছ্বাস উদ্‌গীরিত হইয়া উঠিল–তাহার পর সমস্ত শূন্য, সমস্ত নিস্প্রভ।

এখনকার ভারতসাম্রাজ্য আপিসে এবং আইনে চলে–তাহার রঙচঙ নাই, গীত-বাদ্য নাই, তাহাতে প্রত্যক্ষ মানুষ নাই। ইংরেজের খেলাধুলা, নাচগান, আমোদ-প্রমোদ সমস্ত নিজেদের মধ্যে বদ্ধ–সে আনন্দউৎসবের উদ্‌বৃত্ত খুদকুঁড়াও ভারতবর্ষের জন-সাধারণের জন্য প্রমোদশালার বাহিরে আসিয়া পড়ে না। আমাদের সঙ্গে ইংরেজের সম্বন্ধ আপিসের বাঁধা কাজ এবং হিসাবের খাতা-সহির সম্বন্ধ। প্রাচ্য সম্রাটের ও নবাবের সঙ্গে আমাদের অন্নবস্ত্র শিল্পশোভা আনন্দ-উৎসবের নানা সম্বন্ধ ছিল। তাঁহাদের প্রাসাদে প্রমোদের দীপ জ্বলিলে তাহার আলোক চারি দিকে প্রজার ঘরে ছড়াইয়া পড়িত–তাঁহাদের তোরণদ্বারে যে নহবত বসিত তাহার আনন্দধ্বনি দীনের কুটিরের মধ্যেও প্রতিধ্বনিত হইয়া উঠিত।

ইংরেজ সিভিলিয়ানগণ পরস্পরের আমন্ত্রণে নিমন্ত্রণে সামাজিকতায় যোগদান করিতে বাধ্য, যে ব্যক্তি স্বভাবদোষে এই-সকল বিনোদনব্যাপারে অপটু তাহার উন্নতির অনেক ব্যাঘাত ঘটে। এই সমস্তই নিজেদের জন্য। যেখানে পাঁচটা ইংরেজ আছে সেখানে আমোদ-আহ্লাদের অভাব নাই; কিন্তু সে আমোদে চারি দিক আমোদিত হইয়া উঠে না। আমরা কেবল দেখিতে পাই–কুলিগুলা বাহিরে বসিয়া সন্ত্রস্তচিত্তে পাখার দড়ি টানিতেছে, সহিস ডগ্‌কার্টের ঘোড়ার লাগাম ধরিয়া চামর দিয়া মশামাছি তাড়াইতেছে, এবং দগ্ধ ভারতবর্ষের তপ্ত সংস্রব হইতে সুদূরে যাইবার জন্য রাজপুরুষগণ সিমলার শৈলশিখরে উর্ধ্বশ্বাসে ছুটিয়া চলিয়াছেন। মৃগয়ার সময় বাজে লোকেরা জঙ্গলের শিকার তাড়া করিতেছে এবং বন্দুকের দুটো-একটা গুলি পশুলক্ষ্য হইতে ভ্রষ্ট হইয়া নেটিভের মর্মভেদ করিতেছে। ভারতবর্ষে ইংরেজরাজ্যের বিপুল শাসনকার্য একেবারে আনন্দহীন, সৌন্দর্যহীন-তাহার সমস্ত পথই আপিস-আদালতের দিকে–জনসমাজের হৃদয়ের দিকে নহে। হঠাৎ ইহার মধ্যে একটা খাপছাড়া দরবার কেন? সমস্ত শাসনপ্রণালীর সঙ্গে তাহার কোন্‌খানে যোগ? গাছে লতায় ফুল ধরে, আপিসের কড়িবরগায় তো মাধবীমঞ্জরী ফোটে না। এযেন মরুভূমির মধ্যে মরীচিকার