প্রকল্প সম্বন্ধেপ্রকল্প রূপায়ণেরবীন্দ্র-রচনাবলীজ্ঞাতব্য বিষয়পাঠকের চোখেআমাদের লিখুনডাউনলোডঅন্যান্য রচনা-সম্ভার |
লণ্ডনে আসিয়া একটা হোটেলে আশ্রয় লইলাম; মনে হইল, এখানকার লোকালয়ের দেউড়িতে আনাগোনার পথে আসিয়া বসিলাম। ভিতরে কী হইতেছে খবর পাই না, লোকের সঙ্গে আলাপ-পরিচয়ও হয় না—কেবল দেখি, মানুষ যাইতেছে আর আসিতেছে। এইটুকুই চোখে পড়ে, মানুষের ব্যস্ততার সীমা পরিসীমা নাই; এত অত্যন্ত বেশি দরকার কিসের তাহা আমরা বুঝিতে পারি না। এই প্রচণ্ড ব্যস্ততার ধাক্কাটা কোন্খানে গিয়া লাগিতেছে, তাহাতে ক্ষতি করিতেছে কি বৃদ্ধি করিতেছে তাহার কোনো হিসাব কেহ রাখিতেছে কি না কিছুই জানি না। ঢং ঢং করিয়া ঘণ্টা বাজে, আহারের স্থানে গিয়া দেখি—এক-একটা ছোটো টেবিল ঘেরিয়া দুই-তিনটি করিয়া স্ত্রীপুরুষ নিঃশব্দে আহার করিতেছে; পাত্র হাতে দীর্ঘকায় পরিবেশক গম্ভীরমুখে দ্রুতপদে ক্ষিপ্রহস্তে পরিবেষন করিয়া চলিয়াছে; কেহ কেহ বা খাইতে খাইতেই খবরের কাগজ পড়া সারিয়া লইতেছে; তাহার পরে ঘড়িটা খুলিয়া একবার তাকাইয়া টুপিটা মাথায় চাপিয়া দিয়া, হন্ হন্ করিয়া চলিয়া যাইতেছে; ঘর শূন্য হইতেছে। কেবল আহারের সময় বার-কয়েক কয়েকজন মানুষ একত্র হয়, তাহার পরে কে কোথায় যায় কেহ তাহার ঠিকানা রাখে না। আমার কোনো প্রয়োজন নাই; সকলের দেখাদেখি মিথ্যা এক-একবার ঘড়ি খুলিয়া দেখি, আবার ঘড়ি বন্ধ করিয়া পকেটে রাখি। যখন আহারেরও সময় নয়, নিদ্রারও সময় নহে, তখন হোটেলে যেন ডাঙায় বাঁধা নৌকার মতো—তখন যদি সেখানে থাকিতে হয় তবে কেন যে আছি তাহার কোনো কৈফিয়ত ভাবিয়া পাওয়া যায় না। যাহাদের বাসস্থান নাই, কেবল কর্মস্থানই আছে, তাহাদেরই পক্ষে হোটেল মানায়। যাহারা আমার মতো নিতান্ত অনাবশ্যক লোক তাহাদের পক্ষে বাসের আয়োজনটা এমনতরো পাইকারি রকমের হইলে পোষায় না। জানলা খুলিয়া দেখি, জনস্রোত নানা দিকে ছুটিয়া চলিয়াছে। মনে মনে ভাবি, ইহারা যেন কোন্-এক অদৃশ্য কারিগরের হাতুড়ি। যে জিনিসটা গড়িয়া উঠিতেছে সেটাও মোটের উপর অদৃশ্য; মস্ত একটা ইতিহাসের কারখানা; লক্ষ লক্ষ হাতুড়ি দ্রুত প্রবল বেগে লক্ষ লক্ষ জায়গায় আসিয়া পড়িতেছে। আমি সেই এঞ্জিনের বাহিরে দাঁড়াইয়া চাহিয়া থাকি—ক্ষুধার স্টীমে চালিত সজীব হাতুড়িগুলা দুনিবার বেগে ছটিতেছে, ইহাই দেখিতে পাই।
যাহারা বিদেশী, প্রথম এখানে আসিয়া এখানকার ইতিহাস-বিধাতার এই অতি-বিপুল মানুষ-কালের চেহারাটাই তাহাদের চোখে পড়ে। কী দাহ, কী শব্দ, কী চাকার ঘূর্ণি। এই লণ্ডন শহরের সমস্ত গতি, সমস্ত কর্মকে একবার চোখ বুজিয়া ভাবিয়া দেখিতে চেষ্টা করি—কী ভয়ঙ্কর অধ্যবসায়। এই অবিশ্রাম বেগ কোন্ লক্ষ্যের অভিমুখে আঘাত করিতেছে এবং কোন্ অব্যক্তকে প্রকাশের অভিমুখে জাগাইয়া তুলিতেছে।
কিন্তু, মানুষকে কেবল এই যন্ত্রের দিক হইতে দেখিয়া তো দিন কাটে না। সেখানে সে মানুষ সেখানে তাহার পরিচয় না পাইলে কী করিতে আসিলাম। কিন্তু, মানুষ যেখানে কল সেখানে দৃষ্টি পড়া যত সহজ, মানুষ যেখানে মানুষ সেখানে তত সহজ নহে। ভিতরকার মানুষ আপনি আসিয়া সেখানে ডাকিয়া না লইয়া গেলে প্রবেশ পাওয়া যায় না। কিন্তু, সে তো থিয়েটারের টিকিট কেনার মতো নহে; সে দাম দিয়া মেলে না, সে বিনামূল্যের জিনিস।
আমার সৌভাগ্যক্রমে একটি সুযোগ ঘটিয়া গেল—আমি একজন বন্ধুর১ দেখা পাইলাম। বাগানের মধ্যে গোলাপ যেমন একটি বিশেষ জাতের ফুল, বন্ধু তেমনি একটি বিশেষ জাতের মানুষ। এক-একটি লোক আছেন পৃথিবীতে তাঁহারা বন্ধু হইয়াই জন্মগ্রহণ
১ উইলিয়ম রোটেন্তস্টাইন (William Rothenstein)