প্রকল্প সম্বন্ধেপ্রকল্প রূপায়ণেরবীন্দ্র-রচনাবলীজ্ঞাতব্য বিষয়পাঠকের চোখেআমাদের লিখুনডাউনলোডঅন্যান্য রচনা-সম্ভার |
বন্দর পার হইয়া জাহাজে গিয়া উঠিলাম। আরও অনেকবার জাহাজে চড়িয়াছি প্রত্যেকবারেই প্রথমটা কেমন মনের মধ্যে একটা সংকোচ উপস্থিত হয়। সে সংকোচ অপরিচিত স্থানে অপরিচিত মানুষের মধ্যে প্রবেশ করিবার সংকোচ নহে। জাহাজটার সঙ্গে নিজের জীবনের বিচ্ছেদ অত্যন্ত বেশি করিয়া অনুভব করি। এ জাহাজ যাহারা গড়িয়াছে, যাহারা চালাইতেছে, তাহারাই এ জাহাজের প্রভু—আমি টাকা দিয়া টিকিট কিনিয়া এখানে স্থান পাইয়াছি। এই সমুদ্রের চিহ্নহীন পথের উপর দিয়া কত বংশ ধরিয়া ইহাদের কত নাবিক আপনার জীবনের অদৃশ্য রেখা রাখিয়া গিয়াছে; বারম্বার কত শত মৃত্যুর দ্বারা তবে এই পথ ক্রমে সরল হইয়া উঠিতেছে। আমি যে আজ এই জাহাজে দিনে নির্ভয়ে আহার বিহার করিতেছি ও রাত্রে নিশ্চিন্ত মনে ঘুমাইতেছি, এই নির্ভয়তা কি শুধু টাকা দিয়া কিনিবার জিনিস। ইহার পশ্চাতে স্তরে স্তরে কত চিন্তা কত সাহসের সঞ্চয় সমুচ্চ হইয়া রহিয়াছে; সেখানে আমাদের কোনো অর্ঘ্য জমা হয় নাই।
যখন এই ইংরেজ স্ত্রী-পুরুষদের দেখি, তাহারা ডেকের উপর খেলিতেছে, ঘুমাইতেছে, হাস্যালাপ করিতেছে, তখন আমি দেখিতে পাই—ইহারা তো কেবলমাত্র জাহাজের উপরে নাই, ইহারা স্বজাতির শক্তির উপর নির্ভর করিয়া আছে। ইহারা নিশ্চয় জানে যাহা করিবার তাহা করা হইয়াছে এবং যাহা করিবার তাহা করা হইবে, সেজন্য ইহাদের সমস্ত জাতি জামিন রহিয়াছে। যদি প্রাণসংশয়-সংকট উপস্থিত হয় তবে কেবল যে কাপ্তেন আছে তাহা নহে, ইহাদের সমস্ত জাতির প্রকৃতিগত উদ্যম ও নিরলস সতর্কতা শেষ মূহূর্ত পর্যন্ত মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করিবার জন্য প্রস্তুত হইয়া রহিয়াছে। ইহারা সেই দৃঢ় ক্ষেত্রের উপর এমন প্রফুল্লমুখে প্রসন্নচিত্তে সঞ্চরণ করিতেছে, চারি দিকের তরঙ্গের প্রতি ভ্রূক্ষেপ করিতেছে না। এই জায়গায় ইহারা নিজেরা যাহা দিয়াছে তাহাই পাইতেছে—আর আমরা যাহা দিই নাই তাহাই লইতেছি; সুতরাং সমুদ্র পার হইতে হইতে দেনা রাখিয়া রাখিয়া যাইতেছি। তাই জাহাজে ডেকের উপরে ইংরেজ যাত্রীদের সঙ্গে একত্র মিলিয়া বসিতে আমার মন হইতে কিছুতে সংকোচ ঘুচিতে চায় না।
ডাঙায় বসিয়া অনেক বিলাতি জিনিস ব্যবহার করিয়া থাকি, সেজন্য মনের মধ্যে এমনতরো দৈন্য বোধ হয় না; জাহাজে আমরা আরও যেন কিছু বেশি লইতেছি। এ তো শুধু কলকারখানা নয়, সঙ্গে সঙ্গে মানুষ আছে। জাহাজ যাহারা চালাইতেছে তাহারা নিজের সাহস দিয়া, শক্তি দিয়া পার করিতেছে; তাহাদের যে মনুষ্যত্বের উপর ভর দিয়া আছি নিজেদের মধ্যে তাহারই যদি কোনো পরিচয় থাকিত তবে যে টাকাটা দিয়া টিকিট কিনিয়াছি তাহার ঝম্ঝমানির সঙ্গে অন্য মূল্যের আওয়াজটাও মিশিয়া থাকিত। আজ মনের মধ্যে এই বড়ো একটা বেদনা বাজে যে, উহারা প্রাণ দিয়া চালাইতেছে আর আমরা টাকা দিয়া চলিতেছি,ইহার মাঝখানে যে একটা প্রকাণ্ড সমুদ্র পড়িয়া রহিল তাহা আমরা কবে কোন্ কালে পার হইতে পারিব! এখনো আরম্ভ করা হয় নাই, এখনো অকাতরে কত প্রাণ দেওয়া বাকি রহিয়াছে—এখনো কত বন্ধন ছিঁড়িতে হইবে, কত সংস্কার দলিতে হইবে, সে কথা যখন ভাবি তখন বুঝিতে পারি, আজ গোটাকয়েক খবরের কাগজের নৌকা বানাইয়া তাহারই খেলার পালের উপর আমরা যে বক্তৃতার ফুঁ লাগাইতেছি তাহাতে আমাদের কিছুই হইবে না।
কূলকিনারার বন্ধন ছাড়াইয়া একেবারে নীল সমুদ্রের মাঝখানে আসিয়া পড়িয়াছি। ভয় ছিল, ডাঙার জীব সমুদ্রের দোলা সহিতে পারিব না—কিন্তু, আরব-সমুদ্রে এখনো মৈসুমের মাতামাতি আরম্ভ হয় নাই। কিছু চঞ্চলতা নাই তাহা নহে, কারণ, পশ্চিমের উজান হাওয়া বহিয়াছে, জাহাজের মুখের উপর ঢেউয়ের আঘাত লাগিতেছে, কিন্তু এখনো তাহাতে আমার শরীরের অন্তবিভাগে কোনো আন্দোলন উপস্থিত করিতে পারে নাই। তাই সমুদ্রের সঙ্গে আমার প্রথম সম্ভাষণটা প্রণয়সম্ভাষণ দিয়াই শুরু