নৌকাডুবি
অভিশাপ কুড়াইব?”

এই বলিয়া বিছানার উপরে চিঠিখানা ফেলিয়া উমিকে কমলার হস্ত হইতে উদ্ধার করিয়া লইয়া চলিয়া গেল।

লেফাফাটা লইয়া একটুখানি নাড়াচাড়া করিয়া কমলা চিঠিখানা খুলিল; প্রথম দুই-চারি লাইনের উপরে দৃষ্টিপাত করিয়াই তাহার মুখ লাল হইয়া উঠিল। লজ্জায় সে চিঠিখানা একবার ছুঁড়িয়া ফেলিয়া দিল। প্রথম ধাক্কার এই প্রবল বিতৃষ্ণার আক্ষেপ সামলাইয়া লইয়া আবার সেই চিঠি মাটি হইতে তুলিয়া সমস্তটা সে পড়িল। সমস্তটা সে ভালো করিয়া বুঝিল কি না বুঝিল জানি না; কিন্তু তার মনে হইল যেন সে হাতে করিয়া একটা পঙ্কিল পদার্থ নাড়িতেছে। চিঠিখানা আবার সে ফেলিয়া দিল। যে ব্যক্তি তাহার স্বামী নহে তাহারই ঘর করিতে হইবে, এইজন্য এই আহ্বান! রমেশ জানিয়া শুনিয়া এতদিন পরে তাহাকে এই অপমান করিল! গাজিপুরে আসিয়া রমেশের দিকে কমলা যে তাহার হৃদয় অগ্রসর করিয়া দিয়াছিল, সে কি রমেশ বলিয়া না তাহার স্বামী বলিয়া? রমেশ তাহাই লক্ষ্য করিয়াছিল, সেইজন্যেই অনাথার প্রতি দয়া করিয়া তাহাকে আজ এই ভালোবাসার চিঠি লিখিয়াছে। ভ্রমক্রমে রমেশের কাছে যেটুকু প্রকাশ পাইয়াছিল সেটুকু কমলা আজ কেমন করিয়া ফিরাইয়া লইবে— কেমন করিয়া! এমন লজ্জা, এমন ঘৃণা কমলার অদৃষ্টে কেন ঘটিল! সে জন্মগ্রহণ করিয়া কাহার কাছে কী অপরাধ করিয়াছে? এবারে ‘ঘর’ বলিয়া একটা বীভৎস জিনিস কমলাকে গ্রাস করিতে আসিতেছে, কমলা কেমন করিয়া রক্ষা পাইবে! রমেশ যে তাহার কাছে এতবড়ো বিভীষিকা হইয়া উঠিবে, দুই দিন আগে তাহা কি কমলা স্বপ্নেও কল্পনা করিতে পারিত?

ইতিমধ্যে দ্বারের কাছে উমেশ আসিয়া একটুখানি কাশিল। কমলার কাছে কোনো সাড়া না পাইয়া সে আস্তে আস্তে ডাকিল, “মা!” কমলা দ্বারের কাছে আসিল, উমেশ মাথা চুলকাইয়া বলিল, “মা, আজ সিধুবাবুরা মেয়ের বিবাহে কলিকাতা হইতে একটা যাত্রার দল আনাইয়াছেন।”

কমলা কহিল, “বেশ তো উমেশ, তুই যাত্রা শুনতে যাস।”

উমেশ। কাল সকালে কি ফুল তুলিয়া আনিয়া দিতে হইবে?

কমলা। না না, ফুলের দরকার নেই।

উমেশ যখন চলিয়া যাইতেছিল হঠাৎ কমলা তাহাকে ফিরিয়া ডাকিল; কহিল, “ও উমেশ, তুই যাত্রা শুনিতে যাইতেছিস, এই নে, পাঁচটা টাকা নে।”

উমেশ আশ্চর্য হইয়া গেল। যাত্রা শুনিবার সঙ্গে পাঁচটা টাকার কী যোগ তাহা সে কিছুই বুঝিতে পারিল না। কহিল, “মা, শহর হইতে কি তোমার জন্য কিছু কিনিয়া আনিতে হইবে?”

কমলা। না না, আমার কিছুই চাই নে। তুই রাখিয়া দে, তোর কাজে লাগিবে।

হতবুদ্ধি উমেশ চলিয়া যাইবার উপক্রম করিলে কমলা আবার তাহাকে ডাকিয়া কহিল, “উমেশ, তুই এই কাপড় পরিয়া যাত্রা শুনিতে যাইবি নাকি, তোকে লোকে বলিবে কী?”

লোকে যে উমেশের নিকট সাজসজ্জা সম্বন্ধে অত্যন্ত বেশি প্রত্যাশা করে এবং ত্রুটি দেখিলে আলোচনা করিয়া থাকে, উমেশের এরূপ ধারণা ছিল না— এই কারণে ধুতির শুভ্রতা ও উত্তরচ্ছদের একান্ত অভাব সম্বন্ধে সে সম্পূর্ণ উদাসীন ছিল। কমলার প্রশ্ন শুনিয়া উমেশ কিছু না বলিয়া একটুখানি হাসিল।

কমলা তাহার দুই জোড়া শাড়ি বাহির করিয়া উমেশের কাছে ফেলিয়া দিয়া কহিল, “এই নে, যা, পরিস।”

শাড়ির চওড়া বাহারে পাড় দেখিয়া উমেশ অত্যন্ত উৎফুল্ল হইয়া উঠিল, কমলার পায়ের কাছে পড়িয়া ঢিপ করিয়া প্রণাম করিল, এবং হাস্যদমনের বৃথা চেষ্টায় সমস্ত মুখখানাকে বিকৃত করিয়া চলিয়া গেল। উমেশ চলিয়া গেলে কমলা দুই ফোঁটা চোখের