নৌকাডুবি

        এ-সব কথার মীমাংসা ধীরে ধীরে ক্রমে ক্রমে হইবে; ব্যস্ত হইয়া ফল নাই। যেদিন আমার

চিঠি পাইবে তাহার পরের দিন সকালবেলাতেই আমি গাজিপুরে পৌঁছিব। তোমার কাছে আমার অনুরোধ এই,

গাজিপুরে পৌঁছিয়া আমাদের বাসাতেই যেন তোমাকে দেখিতে পাই। অনেক দিন গৃহহারার মতো কাটিল— আর

আমার ধৈর্য নাই— এবারে গৃহের মধ্যে প্রবেশ করিব, হৃদয়লক্ষ্মীকে গৃহলক্ষ্মীর মূর্তিতে দেখিব। সেই মুহূর্তে

দ্বিতীয়বার আমাদের শুভদৃষ্টি হইবে। মনে আছে— আমাদের প্রথমবার সেই শুভদৃষ্টি? সেই জ্যোৎস্নারাত্রে, সেই

নদীর ধারে, জনশূন্য বালুমরুর মধ্যে? সেখানে ছাদ ছিল না, প্রাচীর ছিল না, পিতামাতাভ্রাতা-

আত্মীয়প্রতিবেশীর সম্বন্ধ ছিল না— সে যে গৃহের একেবারে বাহির। সে যেন স্বপ্ন, সে যেন কিছুই সত্য নহে।

সেইজন্য আর-একদিন স্নিগ্ধনির্মল প্রাতঃকালের আলোকে, গৃহের মধ্যে, সত্যের মধ্যে, সেই শুভদৃষ্টিকে সম্পূর্ণ

করিয়া লইবার অপেক্ষা আছে। পুণ্যপৌষের প্রাতঃকালে আমাদের গৃহদ্বারে তোমার সরল সহাস্য মুর্তিখানি

চিরজীবনের মতো আমার হৃদয়ের মধ্যে অঙ্কিত করিয়া লইব, এইজন্য আমি আগ্রহে পরিপূর্ণ হইয়া আছি।

প্রিয়তমে, আমি তোমার হৃদয়ের দ্বারে অতিথি, আমাকে ফিরাইয়ো না— প্রসাদভিক্ষু রমেশ।


৩৭

শৈল ম্লান কমলাকে একটুখানি উৎসাহিত করিয়া তুলিবার জন্য কহিল, “আজ তোমাদের বাংলায় যাইবে না।”

কমলা কহিল, “না, আর দরকার নাই।”

শৈল। তোমার ঘর-সাজানো শেষ হইয়া গেল?

কমলা। হাঁ ভাই, শেষ হইয়া গেছে।

কিছুক্ষণ পরে আবার শৈল আসিয়া কহিল, “একটা জিনিস যদি দিই তো কী দিবি বল্‌?”

কমলা কহিল, “আমার কী আছে দিদি?”

শৈল। একেবারে কিছুই নাই?

কমলা। কিছুই না।

শৈল কমলার কপোলে করাঘাত করিয়া কহিল, “ইস, তাই তো! যা-কিছু ছিল সমস্ত বুঝি একজনকে সমর্পণ করিয়া দিয়াছিস? এটা কী বল্‌ দেখি।” বলিয়া শৈল অঞ্চলের ভিতর হইতে একটা চিঠি বাহির করিল।

লেফাফায় রমেশের হস্তাক্ষর দেখিয়া কমলার মুখ তৎক্ষণাৎ পাংশুবর্ণ হইয়া গেল— সে একটুখানি মুখ ফিরাইল।

শৈল কহিল, “ওগো, আর অভিমান দেখাইতে হইবে না, ঢের হইয়াছে। এ দিকে চিঠিখানা ছোঁ মারিয়া লইবার জন্য মনটার ভিতরে ধড়্‌ফড়্‌ করিতেছে— কিন্তু মুখ ফুটিয়া না চাহিলে আমি দিব না, কখনো দিব না, দেখি কত ক্ষণ পণ রাখিতে পার।”

এমন সময় উমা একটা সাবানের বাক্সে দড়ি বাঁধিয়া টানিয়া আনিয়া কহিল, “মাসি, গ-গ।”

কমলা তাড়াতাড়ি উমিকে কোলে তুলিয়া বারংবার চুমো খাইতে খাইতে শোবার ঘরে লইয়া গেল। উমি তাহার শকটচালনায় অকস্মাৎ বাধাপ্রাপ্ত হইয়া চিৎকার করিতে লাগিল, কিন্তু কমলা কোনোমতেই ছাড়িল না-তাহাকে ঘরের মধ্যে লইয়া গিয়া নানাপ্রকার প্রলাপবাক্যে তাহার মনোরঞ্জন-চেষ্টায় প্রবলবেগে প্রবৃত্ত হইল।

শৈল আসিয়া কহিল, “হার মানিলাম, তোরই জিত— আমি তো পারিতাম না। ধন্যি মেয়ে! এই নে ভাই, কেন মিছে