প্রকল্প সম্বন্ধেপ্রকল্প রূপায়ণেরবীন্দ্র-রচনাবলীজ্ঞাতব্য বিষয়পাঠকের চোখেআমাদের লিখুনডাউনলোডঅন্যান্য রচনা-সম্ভার |
বিদায়কালে কমলা শৈলকে প্রণাম করিলে পর শৈল কহিল, “কাল দুপুরবেলা আমি তোদের ওখানে যাইব।”
কমলা তাহার উত্তরে হাঁ-না কিছুই বলিল না।
বাংলায় গিয়া কমলা দেখিল উমেশ আসিয়াছে। কমলা কহিল, “তুই যে! যাত্রা শুনিতে যাবি না?”
উমেশ কহিল, “তুমি যে আজ এখানে থাকিবে, আমি— ”
কমলা। আচ্ছা আচ্ছা, সে তোর ভাবিতে হইবে না। তুই যাত্রা শুনিতে যা, এখানে বিষণ আছে। যা, দেরি করিস নে।”
উমেশ। এখনো তো যাত্রার অনেক দেরি।
কমলা। তা হোক-না, বিয়েবাড়িতে কত ধুম হইতেছে, ভালো করিয়া দেখিয়া আয় গে যা।
এ সম্বন্ধে উমেশকে অধিক উৎসাহিত করিবার প্রয়োজন ছিল না। সে চলিয়া যাইতে উদ্যত হইলে কমলা হঠাৎ তাহাকে ডাকিয়া কহিল, “দেখ্, খুড়োমশায় আসিলে তুই— ”
এইটুকু বলিয়া কথাটা কী করিয়া শেষ করিতে হইবে ভাবিয়া পাইল না। উমেশ হাঁ করিয়া দাঁড়াইয়া রহিল। কমলা খানিক ক্ষণ ভাবিয়া কহিল, “মনে রাখিস, খুড়োমশায় তোকে ভালোবাসেন, তোর যখন যা দরকার হইবে, আমার প্রণাম জানাইয়া তুই তাঁর কাছে চাস, তিনি দিবেন— তাঁকে আমার প্রণাম দিতে কখনো ভুলিস নে— জানিস?”
উমেশ এই অনুশাসনের কোনো অর্থ না বুঝিয়া “যে আজ্ঞে” বলিয়া চলিয়া গেল।
অপরাহ্নে বিষণ জিজ্ঞাসা করিল, “মাজি, কোথায় যাইতেছ?”
কমলা কহিল, “গঙ্গায় স্নান করিতে চলিয়াছি।”
বিষণ কহিল “সঙ্গে যাইব?”
কমলা কহিল, “না, তুই ঘরে পাহারা দে।” বলিয়া তাহার হাতে অনাবশ্যক একটা টাকা দিয়া কমলা গঙ্গার দিকে চলিয়া গেল।
একদিন অপরাহ্নে হেমনলিনীর সহিত একত্রে নিভৃতে চা খাইবার প্রত্যাশায় অন্নদাবাবু তাহাকে সন্ধান করিবার জন্য দোতলায় আসিলেন; দোতলায় বসিবার ঘরে তাহাকে খুঁজিয়া পাইলেন না, শুইবার ঘরেও সে নাই। বেহারাকে জিজ্ঞাসা করিয়া জানিলেন, হেমনলিনী বাহিরে কোথাও যায় নাই। তখন অত্যন্ত উৎকণ্ঠিত হইয়া অন্নদা ছাদের উপরে উঠিলেন।
তখন কলিকাতা শহরের নানা আকার ও আয়তনের বহুদূরবিস্তৃত ছাদগুলির উপরে হেমন্তের অবসন্ন রৌদ্র ম্লান হইয়া আসিয়াছে, দিনান্তের লঘু হাওয়াটি থাকিয়া থাকিয়া যেমন-ইচ্ছা ঘুরিয়া ফিরিয়া যাইতেছে। হেমনলিনী চিলের ছাদের প্রাচীরের ছায়ায় চুপ করিয়া বসিয়া ছিল।
অন্নদাবাবু কখন তাহার পিছনে আসিয়া দাঁড়াইলেন তাহা সে টেরও পাইল না। অবশেষে অন্নদাবাবু যখন আস্তে আস্তে তাহার পাশে আসিয়া তাহার কাঁধে হাত রাখিলেন তখন সে চমকিয়া উঠিল এবং পরক্ষণেই লজ্জায় তাহার মুখ লাল হইয়া উঠিল। হেমনলিনী তাড়াতাড়ি উঠিয়া পড়িবার পূর্বেই অন্নদাবাবু তাহার পাশে বসিলেন। একটুখানি চুপ করিয়া থাকিয়া দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া কহিলেন, “হেম, এই সময়ে তোর মা যদি থাকিতেন! আমি তোর কোনো কাজেই লাগিলাম না।”