আত্মপরিচয় ৩

চলেছে মানবযাত্রী যুগ হতে যুগান্তরপানে

ঝড়ঝঞ্ঝা-বজ্রপাতে, জ্বালায়ে ধরিয়া সাবধানে

অন্তর-প্রদীপখানি। শুধু জানি, যে শুনেছে কানে

তাহার আহ্বানগীত, ছুটেছে সে নির্ভীক পরানে

সংকট-আবর্তনমাঝে, দিয়েছে সে বিশ্ব বিসর্জন,

নির্যাতন লয়েছে সে বক্ষ পাতি, মৃত্যুর গর্জন

শুনেছে সে সংগীতের মতো। দহিয়াছে অগ্নি তারে,

বিদ্ধ করিয়াছে শূল, ছিন্ন তারে করেছে কুঠারে,

সর্ব প্রিয়বস্তু তার অকাতরে করিয়া ইন্ধন

চিরজন্ম তারি লাগি জ্বেলেছে সে হোমহুতাশন —

হৃৎপিণ্ড করিয়া ছিন্ন রক্তপদ্ম অর্ঘ্য-উপহারে

ভক্তিভরে জন্মশোধ শেষ পূজা পূজিয়াছে তারে

মরণে কৃতার্থ করি প্রাণ।

এর পর থেকে বিরাটচিত্তের সঙ্গে মানবচিত্তের ঘাত-প্রতিঘাতের কথা ক্ষণে ক্ষণে আমার কবিতার মধ্যে দেখা দিতে লাগল। দুইয়ের এই সংঘাত যে কেবল আরামের, কেবল মাধুর্যের তা নয়। অশেষের দিক থেকে যে আহ্বান এসে পৌঁছয় সে তো বাঁশির ললিত সুরে নয়। তাই সেই সুরের জবাবেই আছে —

রে মোহিনী, রে নিষ্ঠুরা,         ওরে রক্তলোভাতুরা

   কঠোর স্বামিনী,

দিন মোর দিনু তোরে         শেষে নিতে চাস হরে

   আমার যামিনী?

জগতে সবারি আছে         সংসারসীমার কাছে

   কোনোখানে শেষ,

কেন আসে মর্মচ্ছেদি         সকল সমাপ্তি ভেদি

   তোমার আদেশ?

বিশ্বজোড়া অন্ধকার         সকলেরি আপনার

   একেলার স্থান,

কোথা হতে তারো মাঝে         বিদ্যুতের মতো বাজে

   তোমার আহ্বান?

এ আহ্বান এ তো শক্তিকেই আহ্বান ; কর্মক্ষেত্রেই এর ডাক ; রস-সম্ভোগের কুঞ্জকাননে নয় — সেইজন্যেই এর শেষ উত্তর এই —

হবে, হবে, হবে জয়         হে দেবী, করি নে ভয়,

   হব আমি জয়ী।