আত্মপরিচয় ৩

নব সংগীতে নূতন ছন্দ,

হৃদয়সাগরে পূর্ণচন্দ্র

জাগাবে নবীন বাসনা।

কিন্তু এতেও বাজনার সুর। যদিও এ সুর মন্দ্র বটে, কিন্তু মধুর মন্দ্র। যাই হোক কবিতার গতিটা এখানে প্রকৃতির ধাপ থেকে মানুষের ধাপে উঠছে। বিরাটের চিন্ময়তার পরিচয় লাভ করছে। তাই ওই কবিতাতেই আছে—

ওই কে বাজায় দিবসনিশায়

বসি অন্তর-আসনে

কালের যন্ত্রে বিচিত্র সুর —

কেহ শোনে, কেহ না শোনে।

অর্থ কী তার ভাবিয়া না পাই,

কত গুণী জ্ঞানী চিন্তিছে তাই,

মহান মানবমানস সদাই

উঠে পড়ে তারি শাসনে।

বিশ্বমানবের ইতিহাসকে যে একজন চিন্ময় পুরুষ সমস্ত বাধাবিঘ্ন ভেদ করে দুর্গম বন্ধুর পথ দিয়ে চালনা করছেন এখানে তাঁরই কথা দেখি। এখন হতে নিরবিচ্ছিন্ন শান্তির পালা শেষ হল।

কিন্তু বিরোধ-বিপ্লবের ভিতর দিয়ে মানুষ যে ঐক্যটি খুঁজে বেড়াচ্ছে সেই ঐক্যটি কী। সেই হচ্ছে শিবম্‌। এই-যে মঙ্গল এর মধ্যে একটা মস্ত দ্বন্দ্ব। অঙ্কুর এখানে দুই ভাগ হয়ে বাড়তে চলেছে, সুখদুঃখ, ভালোমন্দ। মাটির মধ্যে যেটি ছিল সেটি এক, সেটি শান্তম্‌, সেখানে আলো-আঁধারের লড়াই ছিল না। লড়াই যেখানে বাধল সেখানে শিবকে যদি না জানি তবে সেখানকার সত্যকে জানা হবে না। এই শিবকে জানার বেদনা বড়ো তীব্র। এইখানে ‘মহদ্‌ভয়ং বজ্রমুদ্যতম্‌' কিন্তু এই বড়ো বেদনার মধ্যেই আমাদের ধর্মবোধের যথার্থ জন্ম। বিশ্বপ্রকৃতির বৃহৎ-শান্তির মধ্যে তার গর্ভবাস। আমার নিজের সম্বন্ধে নৈবেদ্যে'র দুটি কবিতায় এ কথা বলা আছে।

মাতৃস্নেহবিগলিত স্তন্যক্ষীররস

পান করি হাসে শিশু আনন্দে অলস —

তেমনি বিহ্বল হর্ষে ভাবরসরাশি

কৈশোরে করেছি পান, বাজায়েছি বাঁশি

প্রমত্ত পঞ্চম সুরে — প্রকৃতির বুকে

লালনললিত চিত্ত শিশুসম সুখে

ছিনু শুয়ে, প্রভাত-শর্বরী-সন্ধ্যা-বধূ

নানা পাত্রে আনি দিত নানাবর্ণ মধু

পুষ্পগন্ধে-মাখা। আজি সেই ভাবাবেশ