প্রকল্প সম্বন্ধেপ্রকল্প রূপায়ণেরবীন্দ্র-রচনাবলীজ্ঞাতব্য বিষয়পাঠকের চোখেআমাদের লিখুনডাউনলোডঅন্যান্য রচনা-সম্ভার |
৩
কোথায় সেই অবিশ্রাম জলকল্লোল, শত লক্ষ তরঙ্গের অহোরাত্র উৎসব, কোথায় সেই অবিরল বনশ্রেণী, আকাশের সেই অবারিত নীলিমা, ধরণীর নবযৌবনে পরিপূর্ণ হৃদয়োচ্ছাসের ন্যায় সেই অনন্তের দিকে চির-উচ্ছ্বসিত বিচিত্র তরুতরঙ্গ, কোথায় সেই প্রকৃতির শ্যামল স্নেহের মধ্যে প্রচ্ছন্ন শিশু লোকালয়গুলি –ঊর্ধ্বে সেই চিরস্থির আকাশের নিম্নে সেই চিরচঞ্চলা স্রোতস্বিনী! চিরস্তব্ধের সহিত চিরকোলাহলময়ের, সর্বত্রসমানের সহিত চিরবিচিত্রের, নির্বিকারের সহিত চিরপরিবর্তনশীলের অবিচ্ছেদ প্রেমের মিলন কোথায়! এখানে সুরকিতে ইঁটেতে, ধূলিতে নাসারন্ধ্রে, গাড়িতে ঘোড়াতে হঠযোগ চলিতেছে। এখানে চারিদিকে দেয়ালের সহিত দেয়ালের, দরজার সহিত হুড়কার, কড়ির সহিত বরগার, চাপ্কানের সহিত বোতামের আঁটা-আঁটি মিলন।
পাঠকেরা বোধ করি বুঝিতে পারিয়াছেন, এতদিন সরেজমিনে লেখা চলিতেছিল –সরে-জমিনে না হউক সরে-জলে বটে –এখন আমরা ডাঙার ধন ডাঙায় ফিরিয়া আসিয়াছি। এখন সেখানকার কথা এখানে, পূর্বেকার কথা পরে লিখিতে হইতেছে, সুতরাং এখন যাহা লিখিব তাহার ভুলচুকের জন্য দায়ী হইতে পারিব না।
এখন মধ্যাহ্ন। আমার সমুখে একটা ডেক্স, পাপোশে একটা কালো মোটা কুকুর ঘুমাইতেছে, বারান্দায় শিকলি-বাঁধা একটা বাঁদর লেজের উকুন বাছিতেছে, তিনটে কাক আলিসার উপরে বসিয়া অকারণ চেঁচাইতেছে এবং এক-একবার খপ করিয়া বাঁদরের ভুক্তাবশিষ্ট ভাত এক চঞ্চু লইয়া ছাদের উপরে উঠিয়া বসিতেছে। ঘরের কোণে একটা প্রাচীন হারমোনিয়ম-বাদ্যের মধ্যে গোটাকতক ইঁদুর খট্ খট্ করিতেছে। কলিকাতা শহরের ইমারতের একটি শুষ্ক কঠিন কামরা, ইহারই মধ্যে আমি গঙ্গার আবাহন করিতেছি-তপঃক্ষীণ জহ্নুমুনির শুষ্ক পাকস্থলীর অপেক্ষা এখানে ঢের বেশি স্থান আছে। আর, স্থানসংকীর্ণতা বলিয়া কোনো পদার্থ প্রকৃতির মধ্যে নাই। সে আমাদের মনে। দেখো –বীজের মধ্যে অরণ্য, একটি জীবের মধ্যে তাহার অনন্ত বংশপরম্পরা। আমি যে ঐ স্টীফেন সাহেবের এক বোতল ব্লু-ব্ল্যাক কালি কিনিয়া আনিয়াছি, উহারই প্রত্যেক ফোঁটার মধ্যে কত পাঠকের সুষুপ্তি মাদার-টিংচার আকারে বিরাজ করিতেছে। এই বালির বোতল দৈবক্রমে যদি সুযোগ্য হাতে পড়িত তবে ওটাকে দেখিলে ভাবিতাম, সৃষ্টির পূর্ববর্তী অন্ধকারের মধ্যে এই বিচিত্র আলোকময় অমর জগৎ যেমন প্রচ্ছন্ন ছিল তেমনি ঐ এক বোতল অন্ধকারের মধ্যে কত আলোকময় নূতন সৃষ্টি প্রচ্ছন্ন আছে। একটা বোতল দেখিয়াই এত কথা মনে উঠে, যেখানে স্টীফেন সাহেবের কালির কারখানা সেখানে দাঁড়াইয়া একবার