কৌতুকহাস্য

শীতের সকালে রাস্তা দিয়া খেজুর-রস হাঁকিয়া যাইতেছে। ভোরের দিককার ঝাপসা কুয়াশাটা কাটিয়া গিয়া তরুণ রৌদ্রে দিনের আরম্ভ-বেলাটা একটু উপভোগযোগ্য আতপ্ত হইয়া আসিয়াছে। সমীর চা খাইতেছে, ক্ষিতি খবরের কাগজ পড়িতেছে এবং ব্যোম মাথার চারি দিকে একটা অত্যন্ত উজ্জ্বল নীলে সবুজে মিশ্রিত গলাবন্ধের পাক জড়াইয়া একটা অসংগত মোটা লাঠি হস্তে সম্প্রতি আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে।

অদূরে দ্বারের নিকট দাঁড়াইয়া স্রোতস্বিনী এবং দীপ্তি পরস্পরের কটিবেষ্টন করিয়া কী-একটা রহস্যপ্রসঙ্গে বারম্বার হাসিয়া অস্থির হইতেছিল। ক্ষিতি এবং সমীর মনে করিতেছিল এই উৎকট নীলহরিৎপেশমরাশি-পরিবৃত সুখাসীন নিশ্চিন্তচিত্ত ব্যোমই ঐ হাস্যরসোচ্ছ্বাসের মূল কারণ।

এমন সময় অন্যমনস্ক ব্যোমের চিত্তও সেই হাস্যরবে আকৃষ্ট হইল। সে চৌকিটা আমাদের দিকে ঈষৎ ফিরাইয়া কহিল–দূর হইতে একজন পুরুষ-মানুষের হঠাৎ ভ্রম হইতে পারে যে, ঐ দুটি সখী বিশেষ কোনো একটা কৌতুককথা অবলম্বন করিয়া হাসিতেছেন। কিন্তু সেটা মায়া। পুরুষজাতিকে পক্ষপাতী বিধাতা বিনা কৌতুকে হাসিবার ক্ষমতা দেন নাই, কিন্তু মেয়েরা হাসে কী জন্য তাহা দেবা ন জানন্তি কুতো মনুষ্যাঃ। চকমকি পাথর স্বভাবত আলোকহীন; উপযুক্ত সংঘর্ষ প্রাপ্ত হইলে সে অট্টশব্দে জ্যোতিঃস্ফুলিঙ্গ নিক্ষেপ করে, আর মানিকের টুকরা আপনা-আপনি আলোয় ঠিকরিয়া পড়িতে থাকে, কোনো-একটা সংগত উপলক্ষের অপেক্ষা রাখে না। মেয়েরা অল্প কারণে কাঁদিতে জানে এবং বিনা কারণে হাসিতে পারে; কারণ ব্যতীত কার্য হয় না, জগতের এই কড়া নিয়মটা কেবল পুরুষের পক্ষেই খাটে।

সমীর নিঃশেষিত পাত্রে দ্বিতীয় বার চা ঢালিয়া কহিল–কেবল মেয়েদের হাসি নয়, হাস্যরসটাই আমার কাছে কিছু অসংগত ঠেকে। দুঃখে কাঁদি, সুখে হাসি, এটুকু বুঝিতে বিলম্ব হয় না। কিন্তু কৌতুকে হাসি কেন? কৌতুক তো ঠিক সুখ নয়। মোটা মানুষ চৌকি ভাঙিয়া পড়িয়া গেলে আমাদের কোনো সুখের কারণ ঘটে এ কথা বলিতে পারি না, কিন্তু হাসির কারণ ঘটে ইহা পরীক্ষিত সত্য। ভাবিয়া দেখিলে ইহার মধ্যে আশ্চর্যের বিষয় আছে।

ক্ষিতি কহিল–রক্ষা করো ভাই। না ভাবিয়া আশ্চর্য হইবার বিষয় জগতে যথেষ্ট আছে; আগে সেইগুলো শেষ করো, তার পরে ভাবিতে শুরু করিয়ো। একজন পাগল তাহার উঠানকে ধূলিশূন্য করিবার অভিপ্রায়ে প্রথমত ঝাঁটা দিয়া আচ্ছা করিয়া ঝাঁটাইল, তাহাতেও সম্পূর্ণ সন্তোষজনক ফল না পাইয়া কোদাল দিয়া মাটি চাঁচিতে আরম্ভ করিল। সে মনে করিয়াছিল এই ধুলোমাটির পৃথিবীটাকে সে নিঃশেষে আকাশে ঝাঁটাইয়া ফেলিয়া অবশেষে দিব্য একটি পরিষ্কার উঠান পাইবে; বলা বাহুল্য, বিস্তর অধ্যবসায়েও কৃতকার্য হইতে পারে নাই। ভ্রাতঃ সমীর, তুমি যদি আশ্চর্যের উপরিস্তর ঝাঁটাইয়া অবশেষে ভাবিয়া আশ্চর্য হইতে আরম্ভ কর তবে আমরা বন্ধুগণ বিদায় লই। কালোহ্যয়ং নিরবধিঃ, কিন্তু সেই নিরবধি কাল আমাদের হাতে নাই।

সমীর হাসিয়া কহিল–ভাই ক্ষিতি, আমার অপেক্ষা ভাবনা তোমারই বেশি। অনেক ভাবিলে তোমাকেও সৃষ্টির একটা মহাশ্চর্য ব্যাপার মনে হইতে পারিত, কিন্তু আরো ঢের বেশি না ভাবিলে আমার সহিত তোমার সেই উঠান মার্জন-কারী আদর্শটির সাদৃশ্য কল্পনা করিতে পারিতে না।

ক্ষিতি কহিল–মাপ করো ভাই; তুমি আমার অনেক কালের বিশেষ পরিচিত বন্ধু, সেইজন্যই আমার মনে এতটা আশঙ্কার উদয় হইয়াছিল যাহা হউক, কথাটা এই যে কৌতুকে আমরা হাসি কেন। ভারী আশ্চর্য! কিন্তু তাহার পরের প্রশ্ন এই যে, যে